Saturday, May 21, 2011

সিঙ্গুরে ৪০০একর ফেরত দেবেন, কীভাবে, তা জানাননি মমতা

আক্রান্তদের পাশে  
নয়ডার গ্রামে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

নতুন মন্ত্রিসভা

মুখ্যমন্ত্রী

মমতা ব্যানার্জি— স্বরাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র (কর্মীবর্গ), ভূমি ও ভূমি রাজস্ব, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি, তথ্য ও সংস্কৃতি, পার্বত্য বিষয়ক, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, মাদ্রাসা শিক্ষা।

পূর্ণমন্ত্রী (তৃণমূল)

১। সুব্রত বক্সি—পূর্ত, পরিবহন।

২। পার্থ চ্যাটার্জি— শিল্প ও বাণিজ্য, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, শিল্প পুনর্গঠন, পরিষদীয়, তথ্যপ্রযুক্তি।

৩। অমিত মিত্র— অর্থ ও আবগারি।

৪। মণীশ গুপ্ত — উন্নয়ন ও পরিকল্পনা।

৫। সুব্রত মুখার্জি— জনস্বাস্থ্য কারিগরি।

৬। আব্দুল করিম চৌধুরী— জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার।

৭। সাধন পাণ্ডে — উপভোক্তা বিষয়ক।

৮। উপেন বিশ্বাস—অনগ্রসর শ্রেণী উন্নয়ন।

৯। জাভেদ আহমেদ খান— দমকল, অসামরিক প্রতিরক্ষা ও বিপর্যয় মোকাবিলা।

১০। রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য— বিদ্যালয় শিক্ষা।

১১। সাবিত্রী মিত্র— সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশু উন্নয়ন।

১২। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক— খাদ্য ও সরবরাহ।

১৩। শান্তিরাম মাহাতো—স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি।

১৪। হায়দার আজিজ সফি— সমবায়, জলপথ পরিবহন।

১৫। মলয় ঘটক— আইন ও বিচারবিভাগ।

১৬। পূর্ণেন্দু বসু— শ্রম।

১৭। ব্রাত্য বসু—উচ্চশিক্ষা।

১৮। রচপাল সিং- পর্যটন।

১৯। হীতেন বর্মণ—বন।

২০। গৌতম দেব— উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন।

২১। নূর ই আলম চৌধুরী— প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন।

২২। শঙ্কর চক্রবর্তী— অচিরাচরিত শক্তি ও কারা।

২৩। রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়— কারিগরি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বায়োটেক।

২৪। সুদর্শন ঘোষদস্তিদার— পরিবেশ।

২৫। উজ্জ্বল বিশ্বাস — যুবকল্যাণ।

২৬। শ্যামাপদ মুখার্জি— আবাসন।

২৭। ফিরহাদ হাকিম—পৌর ও নগরোন্নয়ন।

২৮। সুকুমার হাঁসদা—পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন।

২৯। সৌমেন মহাপাত্র — জলসম্পদ, অনুসন্ধান ও উন্নয়ন।

৩০। অরূপ রায়— কৃষি বিপণন।

৩১। চন্দ্রনাথ সিংহ— পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন।

পূর্ণমন্ত্রী (কংগ্রেস)

১। মানস ভুঁইঞা— সেচ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, বস্ত্র।

২। আবু হেনা— মৎস্য, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, উদ্যান পালন।

রাষ্ট্রমন্ত্রী (তৃণমূল)

১। মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর— উদ্বাস্তু পুনর্বাসন (স্বাধীন দায়িত্ব), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।

২। মদন মিত্র — ক্রীড়া (স্বাধীন দায়িত্ব)

৩। সুব্রত সাহা — পূর্ত

৪। শ্যামল মণ্ডল — সুন্দরবন উন্নয়ন (স্বাধীন দায়িত্ব), সেচ।


সিঙ্গুরে ৪০০একর ফেরত দেবেন,
কীভাবে, তা জানাননি মমতা

নিজস্ব প্রতিনিধি

কলকাতা, ২০শে মে — মহাকরণে, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসাই ছিল তাঁর যাবতীয় কর্মসূচী পাখির চোখ। সেই লক্ষ্যপূরণের জন্যই তিনি এতদিন পথ চলেছেন, ছোটাছুটি করেছেন। বহু সংঘাত, হিংসা, নৈরাজ্যের পথ পেরিয়েই শুক্রবার, ২০শে মে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। আর সেই সাধপূরণের শুক্রবারে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নেরই স্পষ্ট জবাব দিলেন না বা এড়িয়ে গেলেন তিনি। 

এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজেদের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠক করে তৃণমূল। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত হিসাবে সাংবাদিকদের প্রথম যে সিদ্ধান্তের কথা মমতা ব্যানার্জি জানান, তা হলো — সিঙ্গুরের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। 'টাটাবাবু' শিল্প করতে রাজি থাকলে, বাকি ৬০০ একরে করতে পারেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল — ঐ জমি তো এখন টাটাদের কাছেই লিজে রয়েছে। কী করে তার থেকে তিনি কৃষকদের জমি ফেরত দেবেন ? অপছন্দের এই প্রশ্নে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন মুখ্যমন্ত্রীর জবাব —'' আইনেই করা হবে। তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।'' অর্থাৎ কী ভাবে সেই জমি ফেরত দেবেন, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এখনও স্পষ্ট নন। 

অথচ এই ৪০০ একর জমি ফেরতের দাবিকে ভিত্তি করেই দীর্ঘদিন জাতীয় সড়ক অবরোধ থেকে ধর্মতলায় অবরোধ, কত কিছুই তিনি করেছেন।

এমন নজরকাড়া, আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই যৌথবাহিনী প্রত্যাহার এবং মাওবাদী সমস্যার সমাধানের প্রশ্ন। সাংবাদিক সম্মেলনে জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছেন। সেই প্যাকেজে কী থাকবে, বলাবাহুল্য, তা তিনি জানাননি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন — ইউ এ পি এ আইন প্রত্যাহার নিয়ে আপনার কী বক্তব্য ? মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জবাব —'' ইউ এ পি এ নিয়ে কিছু বলার নেই। ওটি কেন্দ্রীয় আইন।'' দ্বিতীয় প্রশ্নটি অবধারিত। জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনী কি প্রত্যাহার করবেন ? এবার কিছুটা উষ্মা দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রীর উচ্চারণে। মমতা ব্যানার্জি বললেন, '' এই তো কাজ শুরু করলাম। লেট মি সী, লেট মি নো।'' 

মমতা ব্যানার্জি বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশিত তাঁর দলের ইশ্‌তেহারের ৪১নং পাতা বলেছিলেন —'' তৃণমূল কংগ্রেস যৌথ অভিযানের নামে জঙ্গলমহল এলাকায় দমন-পীড়নে বিশ্বাস করে না।'' আর ২০০৯-র অক্টোবরে তৃণমূল নেত্রী এক বাংলা নিউজ চ্যানেলে বলেছিলেন, '' ছত্রধরকে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রেপ্তার করতে চায়নি। যৌথ অভিযান বেঠিক কাজ হয়েছে। মাওবাদীদের একটি সুযোগ দেওয়া উচিত। মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতা করা উচিত বিদ্বজ্জনদের।'' সেই সাক্ষাৎকারের প্রায় পৌনে দু'বছর পর, শুক্রবার মহাকরণের রোটান্ডায় সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা ব্যানার্জি বলেন, জঙ্গলমহলের বিষয়ে কোনো সংগঠন কথা বলতে চাইলে আমরা রাজি। রাজ্য সরকার নিজের থেকে কোনো উদ্যোগ নেবে না — এটিই স্পষ্ট করে দিলেন নয়া মুখ্যমন্ত্রী। 

এদিন দার্জিলিঙের সমস্যা প্রসঙ্গেও তাঁর মুখে নতুন কোনো কথা ছিল না। তিনি জানিয়েছেন সেই কথা যা বারবার গত বামফ্রন্ট সরকার জানিয়েছে — আমরা দার্জিলিঙে শান্তি চাই। কিন্তু কীভাবে ? মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন ১৫ দিনের মধ্যে দার্জিলিঙ এবং জঙ্গলমহলের সমস্যার সমাধান করে দেবেন। এদিন সেই সমাধান সূত্রের কোনো কথা তাঁর কাছে মেলেনি। দার্জিলিঙের সমস্যা নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হচ্ছে — এছাড়া তিনি একটি কথাও জানাতে পারেননি।

এদিন মমতা ব্যানার্জি বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারে ভীষণ জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত, বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে তৃণমূল কর্মীরা সি পি আই(এম)-র অফিসে, পার্টিকর্মীদের বাড়িতে হাঙ্গামা চালাচ্ছে। যদিও হলদিয়া, খেজুরি, কেশপুরে এই অস্ত্র উদ্ধার কাণ্ড করতে গিয়ে নিজেরাই বেকায়দায় পড়েছে তৃণমূল কর্মীরা। কেশপুরে তারা সাক্ষী দিতে বাধ্য হয়েছে যে, পার্টি অফিসে কোনো অস্ত্র মেলেনি। খেজুরিতে তৃণমূল কর্মীর পুকুরেই মিলেছে কার্তুজ। এদিন এই অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, '' আমি বর্ডার চেক করতে বলেছি। আমি জানি কোথা দিয়ে অস্ত্র আসে। আমি রেলে ছিলাম তো। একটু একটু জানি এসব।''

পর পর সি পি আই(এম) কর্মী খুন হচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন হাজারো মানুষ, তখন মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেছেন, '' যেভাবে শান্তি বজায় রেখেছেন মানুষ, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।''

এদিন তিনি জানিয়েছেন, '' স্যাটাসাট ফটাফট কাজ দেখার জন্য ৭ দিন লাগবে। এই সময়টা আমাকে দিতে হবে।'' তবে এদিন তিনি যা জানাতে পেরেছেন, তা মূলত বিভিন্ন কমিটি গঠনের সম্ভাবনার কথা। প্রথমত, ''রাজবন্দী, প্রতিহিংসার কারণে, অবিচারের জন্য যারা আটক হয়ে আছেন তাদের মুক্তির জন্য একটি ১০ জনের রিভিউ কমিটি হবে। কেস টু কেস বিচার করবে ঐ কমিটি।'' কমিটিতে প্রাক্তন বিচারপতি, প্রশাসনিক অফিসার, মানবাধিকার কর্মীরাও থাকবেন বলে তিনি জানান। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে রাজ্য সরকার কমিটি বানাবে। বাইশে শ্রাবণ থেকে অনুষ্ঠান হবে। বছরের শেষে বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব হবে। তাঁর অভিযোগ, এ নিয়ে কিছুই করা হয়নি। যদিও বাস্তব তথ্য হলো বিদায়ী সরকার শুধু কমিটিই বানায়নি, সেই কমিটি অনেকগুলি বড় কাজও করে ফেলেছে। অনুষ্ঠানও হয়েছে। মমতা জানিয়েছেন, ২০১৩-তে বিবেকানন্দর জন্মের ১৫০ বছর পূর্তি। তা পালনের জন্য একটি কমিটি হবে। তৃতীয়ত, মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছেন, '' ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ হবে।'' চতুর্থত, মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, '' ফ্লাড, ম্যান মেড ফ্লাড হয়। ডি ভি সি জলে ডুবিয়ে দেয় অনেক এলাকা। সেই জল যাতে নষ্ট না হয়, তা ধরে রাখার জন্য সিস্টেম এক্সপার্ট কমিটি হবে। আমাদের স্লোগান হবে 'জল ধর-জল ভর'। মমতা জানিয়েছেন, বিচারপতি সাচারকে অনুরোধ জানানো হবে রাজ্যে এসে সংখ্যালঘু উন্নয়নে পরামর্শ দিতে।

আর রক্তপাত হবে না তো?
যন্ত্রণা বুকে চেপেই প্রশ্ন শহীদের স্ত্রীদের

নিজস্ব প্রতিনিধি

কলকাতা, ২০শে মে- বারে বারে মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। সাদা কাপড় ও লাল শালুতে ঢাকা স্বামীর মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ছিলেন বুক-ফাটা কান্নায়। তবুও ভানুমতী নন্দীর ইচ্ছাটুকুও পর্যন্ত পালন করতে পারেননি সি পি আই(এম) কর্মীরা, গ্রামবাসীরা। 

সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে এক লহমায় স্তব্ধ করে দেওয়া সেই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন যে কয়েকজন, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তাঁরাও। তবুও সেই অসহায় বিধবা জননীর দাবি মেনে কমরেড জিতেন নন্দীর মৃতদেহের ওপর থেকে কাপড়টুকু সরিয়ে দিয়ে শেষ দেখার সুযোগ করে দিতে পারেননি পার্টিকর্মীরা। কমরেড জিতেন নন্দীর গোটা শরীরে ২৫বার টাঙ্গির কোপের সেই বীভৎস দৃশ্য তাঁর স্ত্রী,সন্তানদের দেখানো যায়নি। সেই যন্ত্রণার সাক্ষী ছিলো গোটা গড়বেতা। ফল ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নপূরণের আনন্দে উন্মত্ত তৃণমূলীদের নারকীয়তার শিকার হয়েছিলেন সি পি আই(এম) গড়বেতা জোনাল কমিটির সদস্য ও ফতেপুরসিং অঞ্চলের বেনাচাপড়া গ্রামের বাসিন্দা কমরেড জিতেন নন্দী। 

মমতা ব্যানার্জি যখন শুক্রবার রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী পদের শপথ নিচ্ছেন তখন ভানুমতী নন্দী তাঁর সন্তানদের নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় রয়েছেন অচেনা জায়গায়। স্বামী হারানোর যন্ত্রণার ভিড়েই মিশে গেছে ঘরছাড়া হওয়ার নিদারুণ কষ্টও। ভানুমতী নন্দী এদিন সন্ধ্যায় শুনেছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা— 'নির্বাচনের পরে রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমি সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, এই শান্তিই তো আমরা চাই'। 

মমতা ব্যানার্জির এই অভিনন্দন বার্তা টেলিভিশনের মাধ্যমে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ হয়েই চেতনায় রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে শহীদ পরিবারের কাছে। শহীদের স্ত্রীর আকুল আর্তি- এই রক্তপাত বন্ধ করুন, আমার স্বামী গরিব মানুষের হয়েই কাজ করতো। তবুও খুন হতে হলো কেন তাঁকে? দয়া করে আর যেন কোন পরিবার নতুন করে আশ্রয় না হারায়'।

নতুন সরকার গঠনের উচ্ছ্বাসে ঢাকা শুক্রবারের সন্ধ্যায় শহীদের স্ত্রীর এই আর্তি হয়ে ওঠেনি কোন সংবাদমাধ্যমের বাইট। তবুও রাজ্যজুড়ে আক্রান্ত, ঘরছাড়া পরিবারের হৃদয়ের উচ্চারণ এটিই। ফল ঘোষণার মাত্র সাতদিনের মধ্যে ছয় জন খুন হয়ে যাওয়ার 'শান্তি' নয়, প্রতিটি পড়শী যেন থাকতে পারে তাঁরই প্রিয় বাসভূমিতে, প্রতিটি দাওয়ায় যেন না মিশে থাকে আক্রান্ত কিংবার ঘরছাড়া হওয়ার আতঙ্ক- এই শান্তির নিশ্চয়তাই চাইছেন রাজ্যবাসী। 

গত আড়াই বছরে গোটা রাজ্যে সাড়ে তিনশো জনেরও বেশি সি পি আই(এম) কর্মী,সমর্থক, গরিব গ্রামবাসী খুন হয়েছেন। রক্তে ভিজেছে এরাজ্যের অনেক জনপদই। নেতাই যেমন হারিয়েছেন নয় জন গ্রামবাসীকে, নেতাইয়ের পড়শী ধরমপুর তেমনই হারিয়েছে ৩২জন সন্তানকে। গোটা জঙ্গলমহল হারিয়েছে ২৭০জনেরও বেশি গ্রামবাসীকে। হিংসার নিদারুণ পথ অতিক্রম করেই নির্বাচনে জিতে মুখ্যমন্ত্রী পদে এদিন শপথ নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।

ফল বেরোনোর মাত্র ৪৮ঘণ্টার মধ্যেই খুন হতে হয়েছে বাঁকুড়ার তালডাংরার শালতোড়ার বাসিন্দা সি পি আই (এম) নেতা কমরেড অজিত লোহারকে। শহীদের স্ত্রী রেনুকা লোহার আজও গর্ববোধ করেন তাঁর স্বামীর কর্মকাণ্ডে। ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের সামনে বসেই ভেঙে পড়ায় কান্নায় সেই রাতে তাঁর গর্বিত উচ্চারণ ছিলো- ওতো গরিবের মজুরি বৃদ্ধির জন্য লড়াই করতো। নির্বাচনে জেতার পরে খুন করতে হয় কেন? 

শুধু শালতোড়া নয় গোটা রাজ্যের প্রতিটি জনপদে এই উচ্চারণ যেন ধাক্কা খেয়ে বেড়িয়েছে। ডুয়ার্স থেকে লাল মাটি- কংসাবতীর তীর থেকে সাগর- এই উচ্চারণ দ্বিগুণ বেগে এদিন নিশ্চিত ধাক্কা খেয়েছে লালদিঘির পাড়ে বাড়িটিতেও। নতুন সরকার হয়েছে, নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এই আর্তি তাঁর ঠিকানার সন্ধান পাবে সেই আশা রাখে শহীদ পরিবার। 

শুক্রবারের সন্ধ্যায় এই আর্তি ধাক্কা খেয়ে পৌঁছেছে জঙ্গলমহলের সেই ঘরছাড়া জননীর কাছেও। শহীদ কমরেড রোহিনী পাতরের স্ত্রী। জনপ্রিয় এই যুবককে গত বছরের নভেম্বরে নৃশংসভাবে খুন করেছিলো আজকের দিনটিই সানন্দে দেখতে চাওয়া মাওবাদীরা। চার বছরের অবুঝ, বড্ড মিষ্টি রিঙ্কিই আজ সোনালি পাতরের একমাত্র সম্বল। আর সম্বল কমরেড রোহিনী পাতরের সেই লালিত স্বপ্ন, লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হোক আদরের রিঙ্কি। 

শাল-পলাশের অজানা জায়গায় আজও আশঙ্কায় দিন গোনা সোনালি পাতরও জেনেছেন মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। স্বামীর জীবনবোধ তাঁর অহঙ্কার। অন্ধকার গ্রাস করা লালমাটির জনপদ অজানা জনপদ থেকে শহীদ ও ঘরছাড়া পরিবারের এই অসহায় জননীর আবেদন ফের এসে ধাক্কা খেয়েছে মহানগরীর এই নিয়ন আলোর রাতেও। কারও সাধপূরণ তো হলো, এবার? 'এই অসহনীয় রক্তপাত নিশ্চয় বন্ধ হবে, বিরুদ্ধ মতের জন্য নিশ্চয় কাউকে আর শহীদের তালিকায় নাম লেখাতে হবে না', কষ্ট বুকে চেপেই বলতে পারলেন তিনি। 

শপথ গ্রহণের আগে মাত্র সাত দিনেই হাজারো ঘরছাড়া, সি পি আই(এম)-র অসংখ্য অফিসে বহ্ন্যুৎসব, বামপন্থী কর্মীদের সশস্ত্র হুমকির মুখে রাখার মতো সন্ত্রাসের দিনলিপি এবার কি বন্ধ হবে?

বিমান বসু:বামপন্থীদের
সৌজন্যবোধ অনেক উন্নত

নিজস্ব প্রতিনিধি

কলকাতা, ২০শে মে- মানুষের স্বার্থে বামপন্থীদের কখনো সৌজন্যবোধের অভাব হয়নি, আগামী দিনেও হবে না। শুক্রবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বামফ্রন্ট চেয়ারম‌্যান এবং সি পি আই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এই মন্তব্য করেছেন। এদিন দুপুরে রাজভবনে রাজ্যে নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বামপন্থীরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, সৌজন্যবোধ সবসময় মেনে চলে। বামপন্থীদের সৌজন্যবোধ অনেক উন্নত পর্যায়ের।

এদিন বিমান বসু বলেন, রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ যখন বিরাটির আশ্রমে মারা যান, তখন আমি এবং অনিল বিশ্বাস, আমরাই প্রথম সেখানে যাই। আশ্রমের টেলিফোন তখন খারাপ ছিল, এত সেলফোনের চলও তখন ছিল না, বিরাটি থেকে সুরঞ্জন ত্রিপাঠী আমাকে ফোন করে খবর জানিয়েছিলেন। আমি সেকথা অনিলকে বলি এবং দু'জনে তখনই সেখানে রওনা হয়েছিলাম। আবার সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যখন মারা যান, আমরা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে গিয়েছি। পূর্বাপর এটা হয়েছে, নতুন নয়। 

নতুন সরকারের কাছে আপনাদের প্রত‌্যাশা কী, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে বিমান বসু বলেন, আমরা চাইবো নতুন সরকার পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থে কাজ করুক, গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করুক। শ্রমিক-কর্মচারী-সাধারণ মানুষের অর্জিত অধিকারগুলি যাতে রক্ষিত হয়, আমরা সেটা চাইবো।


প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানসহ নেতৃবৃন্দ
মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা,শপথ নিলেন আরো ৩৭

নিজস্ব প্রতিনিধি

কলকাতা, ২০শে মে— পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। শুক্রবার একই সঙ্গে শপথ নিয়েছেন কংগ্রেসের ২ জন সহ ৩৩ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ৪ জন প্রতিমন্ত্রী। রাজভবনে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিম সহ রাজ্য বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিসহ রাজনীতি, শিল্প-বাণিজ্য মহলের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদিন বেলা ১টা থেকে মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। শপথ গ্রহণের পরে রাজভবনে রাজ্যপালের আমন্ত্রণে চা-চক্রে কিছু সময় কাটিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী পা'য়ে হেঁটে যান মহাকরণে।

২০০৬ সালের ১৮ই মে এই রাজভবনেই শপথ নিয়েছিলো রাজ্যে চতুর্দশ মন্ত্রিসভা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। তৎকালীন রাজ্যপাল এবং সরকারের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও সেদিন রাজভবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করে তৃণমূল। আমন্ত্রণ সত্ত্বেও তৃণমূলের কেউ-ই আসেননি সেদিন, এমন কি বিধায়করাও ছিলেন অনুপস্থিত। তবে কংগ্রেস ছিলো। জ্ঞান সিং সোহন পাল, দেবপ্রসাদ রায়, অসিত মাল প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা হাজির ছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানে। স্বভাবতই এ‍‌দিনের ঘটনা ছিলো অন্যরকম। বেলা পৌনে ১টা নাগাদ রাজভবনে ঢোকেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সহ ক্ষিতি গোস্বামী, বিশ্বনাথ চৌধুরী, মঞ্জুকুমার মজুমদার, নরেন দে, কিরণময় নন্দ, বরুণ মুখার্জি প্রমুখ ফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। তার কিছুটা আগেই চলে আসেন বিদায়ী অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিম। এতটাই হইচই, হুড়োহুড়ি তখন চলছে যে, হাসিম আব্দুল হালিম পড়েই যেতেন। তাঁর বসার নির্দিষ্ট জায়গায় তখন অন্যজন বসে আছেন। ফলে বিদায়ী অধ্যক্ষকে বসতে হয় অন্যত্র। ১টা বাজতে ৭-৮ মিনিট বাকি, তখন ঢোকেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং অসীম দাশগুপ্ত। ধীরে ধীরে তাঁরা এসে বসেন নির্দিষ্ট জায়গায়। ঠিক তারপরেই রাজভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানস্থলে চলে আসেন মমতা ব্যানার্জি। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী এবং বিমান বসুর উদ্দেশ্যে দ্রুত 'নমস্কার' জানিয়ে তিনি চলে যান মহা‍শ্বেতা দেবী এবং অমলাশঙ্করের কাছে। তাঁদের প্রণাম করে মঞ্চে ‍ওঠেন। তৃণমূল নেত্রী মঞ্চে উঠতেই প্রণব মুখার্জি নজর করেন হাসিম আব্দুল হালিম কিছুটা দূরে এক কোণায় বসে আছেন। প্রণব মুখার্জি উঠে গিয়ে বিদায়ী অধ্যক্ষকে ডেকে নিয়ে এসে বসান একেবারে সামনের সারিতে জ্ঞান সিং সোহন পালের পাশে।

রাজভবনের অনুষ্ঠানস্থলে ৩২০০টি বসার জায়গা। অথচ প্রায় ৫ হাজার মানুষ ঢুকে গেছেন। শিল্পপতি থেকে গায়ক, গায়িকা, অ‍‌ভিনেত্রী অনেকেই বসার জায়গা না পেয়ে ঘুরছেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিশিষ্ট গায়িকা সন্ধ্যা মুখার্জি ভিড়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে অনেকেই নির্দিষ্ট আসনে বসতে না পেরে এদিক-ওদিক জায়গা খুঁজে নিয়ে বসেছেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এন প্যাটেল, প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামলকুমার সেন এবং বীরেন জে শাহ, রেলের দুই রাষ্ট্রমন্ত্রী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ, সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, স্যাম পিত্রোদা, জগমোহন ডালমিয়া, রূপেন রায়, হর্ষ নেওটিয়া, এস কে রায়, পি কে ব্যানার্জি, উষা উত্থুপ সহ সমাজের বিভিন্ন অং‍‌শের বিশিষ্ট মানুষজন অনেকেই হাজির ছিলেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। এছাড়া টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের অনেকেই এদিন উপস্থিত ছিলেন রাজভবনে।

মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা ব্যানার্জি শপথ নেওয়ার পরে শপথ নেন সুব্রত বক্সী। দ্বিতীয় পার্থ চ্যাটার্জি এবং তৃতীয় অমিত মিত্র শপথ নেন। সুব্রত মুখার্জি কংগ্রেস আমলে মন্ত্রিসভায় ছিলেন। আবার পূর্ণমন্ত্রী হলেন। উত্তর দিনাজপুর থেকে আব্দুল করিম চৌধুরী এবং দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে শঙ্কর চক্রবর্তী পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিলে মন্ত্রিসভায় একমাত্র মহিলা এখনো পর্যন্ত মালদহ জেলা থেকে জিতে আসা সাবিত্রী মিত্র। পুরুলিয়া থেকে মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন শান্তিরাম মাহাতো, বর্ধমানের মলয় ঘটক এবং রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। প্রাক্তন বিচারপতি নূরে আলম চৌধুরীও পূর্ণমন্ত্রী। নদীয়া থেকে মন্ত্রী হয়েছেন উজ্জ্বল বিশ্বাস। বীরভূম থেকে শ্যামাপদ মুখার্জি এবং চন্দ্রনাথ সিংহ মন্ত্রী। পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে প্রাক্তন মন্ত্রী সুবোধ হাঁসদার ছেলে সুকুমার হাঁসদা পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুর থেকে মন্ত্রিসভায় এসেছেন সৌমেন মহাপাত্র এবং সুদর্শন ঘোষদস্তিদার। হাওড়া থেকে অরূপ রায়, দার্জিলিঙ থেকে গৌতম দেব পূর্ণমন্ত্রী। এছাড়া উত্তর ২৪ পরগনা এবং কলকাতা থেকে জিতে আসা বেশ কয়েকজন শপথ নিয়েছেন পূর্ণমন্ত্রী পদে। বীণাপাণি দেবীর ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে, মুর্শিদাবাদ থেকে একমাত্র তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী সুব্রত সাহা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে শ্যামল মণ্ডলকে প্রতিমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রাজভবনে তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছিলো তাতে পূর্ণমন্ত্রী পদে বাঁকুড়া থেকে জয়ী কাশীনাথ মিশ্রের নাম ছিলো। পরে বেশি রাতের দিকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। জানা গেছে, তাঁকে ডেপুটি স্পিকার করা হবে। বিধানসভার স্পিকার করা হবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে জিতে আসা বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কংগ্রেসের মানস ভুঁইঞা এবং আবু হেনা এদিন পূর্ণমন্ত্রী পদে শপথ নেন। সব মিলিয়ে ৪৪ জনের মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রী সহ মোট ৩৮ জন শপথ নিয়ে‍‌ছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ৫ জন প্রতিমন্ত্রী এবং ১ জন পূর্ণমন্ত্রী পরে শপথ নেবেন। প্রসঙ্গত, ৫ জন প্রতিমন্ত্রীই কংগ্রেস থেকে শপথ নেওয়ার কথা। এস ইউ সি মন্ত্রিসভায় অংশ নেয়নি। তবে তারা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলো। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে আইনজীবী অনিন্দ্য মিত্রের নাম এদিন তৃণমূল সূত্রে জানা গেছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পার্টিকর্মী, সমর্থকদের
ওপর সমানতালে আক্রমণও চালাচ্ছে তৃণমূল

নিজস্ব প্রতিনিধি

কলকাতা, ২০শে মে— 'দিদি যে দিন শপথ নেবে সেদিনই দেখে নেবো'। বিভিন্ন জেলায় সি পি আই (এম)-র কর্মী সমর্থকদের ঠিক এই ভাষাতেই হুমকি দিয়েছিল তৃণমূল। ঘটলোও তাই। শুক্রবার মন্ত্রিসভার শপথ নেওয়ার দিন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তাঁর দলের কর্মীরা পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বাজিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকলো না, বেশ কিছু জায়গায় বেপরোয়া হামলা চালালো সি পি আই (এম)-র কর্মী, সমর্থকদের উপর। তৃণমূলের ওই হামলায় বেশ কয়েকজন রক্তাক্ত হলেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পরে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই রাজ্যে শান্তি বজায় রয়েছে বলে দাবি করলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাঁর কথায়, এই শান্তিই নাকি কাম্য। যে 'শান্তির' শিকার হয়ে গত কয়েক দিনের মতো এদিনও বেশ কয়েকজন সি পি আই (এম) কর্মীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। 

'দিদির শপথের দিন দেখে নেবো', বলে হুমকি দেওয়ার পর এদিন দুপুর বেলা হাওড়ার শিবপুর থানার কাজিপাড়ায় ভাতের থালা থেকে তুলে সঞ্জয় সিং নামে এক যুবককে তৃণমূল কর্মীরা এমন মার মেরেছে যে তাঁকে প্রথমে হাওড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। তাঁর অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে। 

৩৫বছরের সঞ্জয় সিং সি পি আই (এম)-কে ভোট দিয়েছিলেন বলেই তাঁর উপর এদিন পৈশাচিকভাবে হামলা চালায় তৃণমূল কর্মীরা। দুপুরে স্নান করে খেতে বসেছিলেন সঞ্জয় সিং। রাজভবনে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি যখন শপথ নিচ্ছেন ঠিক সেই সময়েই তৃণমূল কর্মীরা হামলা চালিয়ে ওই যুবককে ভাতের থালা সামনে থেকে তুলে রিভলবারের বাঁট এবং লোহার রড দিয়ে পেট, বুকে, মাথায় আঘাত করে। ওই যুবকের স্ত্রী তৃণমূল কর্মীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে গেলে তাঁকেও ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর 'এদিন আধমরা করে গেলাম। পরে জানে মেরে দেবো', বলে হুমকি দিয়ে চলে যায় তৃণমূলের ওই হামলাকারীরা। এই শিবপুরেই ডি ওয়াই কর্মী সানি গোস্বামীকে বাঁচাতে দিয়ে গিয়ে তৃণমূল কর্মীদের হামলায় জখম হয়েছেন তাঁর ৭৫বছরের বৃদ্ধ বাবা। ওই এলাকার বেশকিছু সি পি আই (এম) সমর্থককে ৩দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে ফতোয়া দিয়েছে তৃণমূল কর্মীরা। 

ভোটের ফল প্রকাশের পর তৃণমূলী সন্ত্রাসে ঘরছাড়া সি পি আই (এম) কর্মীদের অসহায় পরিবারের উপরেও এদিন আক্রমণ চালাতে কসুর করেনি তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী। কলকাতার ৫৭নম্বর ওয়ার্ডের ধাপা অঞ্চলের ডি সি দে রোডের বস্তিতে এই হামলার ঘটনা ঘটে। বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর তৃণমূলের সন্ত্রাসের মুখে এই এলাকায় বাড়ি ছেড়েছিলেন ৩৮নম্বর ডি সি দে রোডের বাসিন্দা বিজয় সাহু। তাঁর মা, বোন ও বোনের সন্তানরা বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন। শুক্রবার সকাল বেলাতেই তৃণমূল কর্মীদের একটি বড় দল এই বাড়ির অসহায় মানুষজনের ওপর হামলা চালায়। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই দুষ্কৃতীর দল ঘরের জিনিসপত্র, বাচ্চাদের খাতা বই থেকে শুরু করে গেরস্থালীর সব জিনিস বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করে। ভাঙতে থাকে আলমারি, বাসনপত্র, টিভি। অতর্কিতে এই আক্রমণের মুখে মহিলারা অসহায় অবস্থায় চিৎকার করতে থাকেন। তাঁদের চিৎকারে বেরিয়ে আসেন এলাকার অন্যান্য মানুষ। একইভাবে এই দুষ্কৃতীর দল হামলা চালায় এই এলাকারই পার্টিকর্মী ঘরছাড়া শ্যামল দাসের বাড়িতে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে তারা পার্টি সমর্থকদের মারধরও করে। ভাঙচুর করা হয়, মোটরবাইক, গাড়ি। তৃণমূল দুষ্কৃতীরা ওই এলাকাতেই সি পি আই (এম)-র একটি শাখা অফিস দখল করতে যায়। কিন্তু মানুষের প্রতিরোধের মুখে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপরই এই দুষ্কৃতীর ৫নম্বর মথুর বাবু লেনে পার্টিকর্মী বিক্রম দাসের বাড়িতে হামলা চালায় তারা। হামলার খবর পেয়ে সি পি আই (এম) নেতৃত্ব ঘটনাস্থলে যান। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে থানায় ডেপুটেশনও দেওয়া হয়। 

পূর্ব কলকাতার তপসিয়া, সি এন রায় রোড, পিকনিক গার্ডেন, জি জে খান রোডসহ বিস্তীর্ণ এলাকাতেও বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে তৃণমূলী বাইক বাহিনীর তাণ্ডব। বেছে বেছে সি পি আই (এম) কর্মীদের বাড়ির সামনে গিয়ে ডেকে ডেকে হুমকি, পার্টি অফিসে হামলা যেমন হচ্ছে তেমনই শুরু হয়েছে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার মোড়ে, গলিতে বাজি ফাটাবার মতো বোমাবাজি। এরই মধ্যে তপসিয়া পোস্ট অফিসের পাশে পার্টির শাখা অফিসে হামলা চালিয়েছে তৃণমূলী বাহিনী। সি পি আই (এম) কর্মী প্রতিবন্ধী যুবক মহম্মদ সেলিমকে প্রচণ্ড মারধর করে তৃণমূলী বাহিনী। তিনি বর্তমানে পাড়া ছাড়া। একই ভাবে পার্টিকর্মী শেখ মোক্তারের বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূলের দুষ্কৃতীর দল। মহম্মদ ইরফান নামে এক ছাত্রকেও তপসিয়া পোস্ট অফিসের সামনে প্রচণ্ড মারধর করে তৃণমূলীরা। জি জে খান রোডের বিনোদ মুদির দোকানও ভেঙে দিয়েছে ওই দুষ্কৃতীর দল। এইভাবেই এলাকাজুড়ে তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ট, বর্তমানে রাজ্যের মন্ত্রী জাভেদ খানের অনুগত তৃণমূল বাহিনী লাগামছাড়া তাণ্ডব চালাচ্ছে। 

এদিন দুপুরে দক্ষিণ ২৪পরগনার বিষ্ণুপুর থানার আন্ধারমানিক এলাকার কলমিকালি গ্রামে সি পি আই (এম) সমর্থক ডাব ব্যবসায়ী মোসারফ শেখকে তৃণমূল কর্মীরা এমন মার মেরেছে যে তাঁকে আমতলা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এদিন সাগরের রুদ্রনগরে ব্লক অফিসে রাজ্য সরকারী কর্মচারী সংগঠনের কার্যালয় দখল করে তাতে তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। উস্থি থানার সিরাকল এলাকার অযোধ্যানগর গ্রামে তৃণমূলের হামলায় জখম হয়েছেন সি পি আই (এম) কর্মী আতিবর শেখ। 

রাজভবনে দলের নেত্রী নেতাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান চলার সময় হুগলীর খানাকুলের গ্রামে গ্রামেও হামলা চালায় তৃণমূলের দুর্বৃত্ত বাহিনী। পূর্ব ঠাকুরানীচকের বারাসত এলাকায় ফেলু পাত্র নামে এক ব্যক্তিকে তৃণমূলীরা এমন মারধর করে যে তাঁকেও আরামবাগ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। আরামবাগের উত্তর নারায়ণপুরে প্রবীর শীট এবং বিশ্বনাথ শীট নামে দুই কৃষকও তৃণমূলের হামলায় মারাত্মক জখম হয়েছেন। পুরশুড়ার বৈকুন্ঠপুরে প্রবীণ পার্টিকর্মী নবকুমার চৌধুরীকেও তৃণমূল কর্মীরা বেধড়ক মারে। তারকেশ্বরের রামনারায়ণপুরে ১১০জন ভাগচাষীকে জমি থেকে থেকে উচ্ছেদ করেছে তৃণমূলীরা। তৃণমূলের ঝাণ্ডা লাগিয়ে গায়ের জোরে দখল করে নেওয়া হয় অনাথ পাঁজা নামে এক ব্যক্তির জমি। তারকেশ্বরেরই মধ্যহাউলি গ্রামে পার্টিকর্মী তপন ভৌমিকের বাড়ি ভাঙচুর করে তার বাড়ি থেকে আসবাবপত্র, গয়না, টাকাপয়সা লুঠ করেছে তৃণমূলীরা। বালিগোড়ি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের পদ থেকে সি পি আই (এম)-র স্বপ্না খাতুনকে পদত্যাগ করানোর জন্য তাঁর উপর মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছে তৃণমূল নেতা অমর উপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ জানা ও তাঁদের দলবল। জয়কৃষ্ণপুরে সি পি আই (এম)-র অফিসে নিজেদের দলের পতাকা লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমূল। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চাঁপাডাঙা ৩নম্বর আঞ্চলিক কমিটির দপ্তর। হুগলী জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শোভা সামন্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁকে খুন করার হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল কর্মীরা। তৃণমূলের হামলা, হুমকির মুখে পড়ছেন পার্টি নেতা কিংশুক আদক, নিশিথ বালিসহ সি পি আই (এম)-র কয়েকশো কর্মী সমর্থক। 

উত্তর ২৪ পরগনার গ্রামে গ্রামেও চলছে তৃণমূলের হামলা। এদিন শাসনের শহরা গ্রামে সি পি আই (এম) কর্মী আলাউদ্দিনকে খুন করার হুমকি দিয়ে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয় তৃণমূলের সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। হামলা হয়ে বুঝে প্রাণভয়ে আগেই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন আলাউদ্দিন। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়ির জিমিসপত্র লুট করে মহিলাদের শ্লীলতাহানি করে তৃণমূল কর্মীরা। হামলা চালানো হয় পানিহাটি এলাকার এক পার্টি শাখার সম্পাদক তুলসী নন্দীর বাড়িতে। বাড়ির সামনে রাখা তাঁর ছেলের অটো রিকশা ভেঙে দেওয়া হয়। বাড়ি তাক করে গুলিও চালানো হয়। ভাঙা হয় ওই এলাকার ডি ওয়াই এফ আই-র কার্যালয়। হাতে পিস্তল নিয়ে এদিন পানিহাটির রামচন্দ্রপুর মেট্রোপলিটন হোমিওপ্যাথি কলেজেও হামলা চালায় তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। পিস্তলের বাঁট দিয়ে ওই কলেজের ছাত্র মহম্মদ আকতারের মাথায় মারা হয়। ঘুঁসি মেরে ফাটিয়ে দেওয়া হয় তাঁর নাক। ওই কলেজের বামপন্থী ছাত্রছাত্রীদের হুমকি দেওয়া হয়।

বারাসতের দত্তপুকুরের ভাঙচুর করা হয়েছে সি পি আই (এম) কর্মী দিলীপ ঘরামি, সঞ্জয় বোস, সুখরঞ্জন হালদারের বাড়ি। বেলঘরিয়ার নন্দননগরে তৃণমূল কাউন্সিলর অজিতা ঘোষের নেতৃত্বে মধ্যপাড়ার একটি ক্লাবে হামলা চালানো হয়। মিনাখাঁর গ্রামগুলিতেও চলছে তৃণমূলের হামলা, হুমকি।

শুক্রবার বিকালে দেগঙ্গার চাকলাতে তৃণমূলীদের আক্রমণে গুরুতর আহত হলেন সেখানকার এক ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী। গুরুতর আহত ঐ ব্যবসায়ীকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঐ আহত ব্যবসায়ীর নাম উজ্জ্বল মণ্ডল।

পুলিসকে নিয়ে তৃণমূলের 'অস্ত্র তল্লাশি'
ষড়যন্ত্র এবার বেআব্রু চন্দ্রকোণাতেও

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর, ২০শে মে - কেশপুরের পর এবার চন্দ্রকোণাতেও 'অস্ত্র তল্লাশি'র গল্প ফেঁদে জনমানসে সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর তৃণমূলী কৌশল বেআব্রু হলো। সেই একই কায়দায় এদিন চন্দ্রকোণার ঝাঁকরায় পার্টির আঞ্চলিক কমিটির দপ্তরে পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের গল্প ফেঁদে 'তল্লাশি' চালায় তৃণমূলীরা। পার্টি অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র, মার্কসীয় সাহিত্যের বই ছাড়া মেলেনি কিছুই। 

ইতোমধ্যেই সি পি আই (এম)-র তরফে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও বেআইনীভাবে একের পর এক পার্টি অফিসে তৃণমূলী ও পুলিসের যৌথ 'তল্লাশি' বন্ধের দাবিও জানানো হয়েছে। যদিও সেই দাবিকে অগ্রাহ্য করেই পুলিস এবং প্রশাসনেরও একাংশ কার্যত তৃণমূলীদের নির্দেশেই সি পি আই (এম) অফিসে অবৈধভাবে 'তল্লাশি' অভিযান চালাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি যখন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিচ্ছেন, সে সময়েই বিজয়োল্লাসে মত্ত তৃণমূলীরা পুলিসকে সঙ্গে নিয়েই ঝাঁকরায় পার্টি অফিসে 'তল্লাশি' চালায়। তৃণমূলের দাবি, সেখানে নাকি অস্ত্র আছে। ঠিক একই কায়দায় বৃহস্পতিবার কেশপুরে পার্টির জোনাল কার্যালয়ে 'তল্লাশি' চালিয়েছিলো পুলিস ও তৃণমূল যৌথভাবে। শেষ পর্যন্ত সেখানে অস্ত্র তো মেলেইনি, বরং তৃণমূলীদের সাক্ষী রেখেই পুলিস যে সিজার লিস্ট দিয়েছে তাতে স্পষ্টই লেখা ছিলো, কিছু কাগজপত্র, ফাইল এবং মার্কসীয় প্রগতিশীল সাহিত্যের বই পাওয়া গেছে। এদিনও ঝাঁকরায় পার্টি অফিসে তল্লাশি চালানোর পর পুলিসের সই করা সিজার লিস্টে অস্ত্র তো দূরের কথা কিছু বইপত্র ও পার্টির কাগজপত্রই মিলেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবুও বারেবারে শুধুমাত্র তৃণমূলীদের আবদার মেনে এভাবেই সি পি আই (এম)-কে হেয় করতে 'তল্লাশি' চালাচ্ছে পুলিস।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাজুড়েই তৃণমূলীদের উন্মত্ত তাণ্ডব অব্যাহত। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন মমতা ব্যানার্জি শপথ পাঠ করছেন রাজভবনে, সেই সময়েই এদিন ঘাটাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দেখলো তৃণমূলী পরিবর্তনের আসল চেহারা। এদিন নতুন বর্ষের ফরম ভর্তির সময়েই বহিরাগত তৃণমূলীরা কলেজের ভিতরে ঢুকে এস এফ আই সমর্থক ছাত্রছাত্রীদের বেধড়ক মারধর করে। তালা ভেঙে ছাত্র সংসদ কক্ষে ঢুকে ইউনিয়ন দখল করে। এমনকি তৃণমূলীদের সেই অবৈধ দখলদারিকে সমর্থন দিতে হবে, এই দাবিতে কলেজের অধ্যক্ষের ওপরেও মানসিকভাবে চাপ দিতে থাকে তৃণমূলী নেতারা। এরপর সশস্ত্র তৃণমূলীদের অন্য একটি বাহিনী হামলা চালায় দাসপুরের লঙ্কাগড়ে সি পি আই (এম)-র শাখা অফিসে। মমতা ব্যানার্জির শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিজয় মিছিলের নামে তৃণমূলী ভৈরব বাহিনী পার্টি অফিসে ঢুকে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর শহীদ বেদীও পর্যন্ত ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। 

মমতা ব্যানার্জির শপথ অনুষ্ঠানের উল্লাসে শুক্রবার দিনভর জেলার বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় তৃণমূলীরা। কেশিয়াড়ি ব্লকের সাঁতরাপুর পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালানোর পরে রক্তপতাকা নামিয়ে তৃণমূলের পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি পার্টি অফিসের দেওয়ালে 'সি পি আই(এম)-র শাখা কার্যালয়' লেখাটি মুছে তৃণমূলের অফিস লিখে দেওয়া হয়। সি আই টি ইউ অফিসেও তৃণমূলের পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে 'গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে'!

এদিন মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণের আনন্দে তৃণমূলীরা বিজয় মিছিলের নামে আমদাতে সি পি আই (এম) কর্মী অমল জানার বাড়িতে ঢুকে তাঁকে মারধর করে। যদিও তৃণমূলীদের এই তাণ্ডবে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা রাস্তায় নেমেই প্রতিবাদ জানান এবং বাধা দেন। আবার মোহনপুর ব্লকের নীলপুরাতে পার্টি সমর্থকদের কাছ থেকে ১লক্ষ টাকা করে জরিমানা আদায়ের হুমকি দেওয়া হয়। এই ব্লকের আঁতলা, মঞ্জুরীবাড়,বাড়শাহানপুর,শ্রীচন্দনপুর প্রভৃতি গ্রামে এইভাবেই পার্টিকর্মীদের কাছ থেকে তোলা আদায় চলছে। 'তৃণমূলীদের তোলা না দিলে থাকতে দেওয়া হবে না গ্রামে'- এই বলে চলছে হুমকিও। 

এদিন নারায়ণগড় ব্লকের গাঙ্গুটিয়াতে শহীদ বিনয় চন্দ্রের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দেয় তৃণমূলীরা। পাতলীতে পার্টির শাখা অফিসে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও বিরবিরাতে পার্টি দপ্তর ভাঙতে এলে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরাই ঐক্যবদ্ধভাবে বাধা দেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গ্রামরাজ অঞ্চলে গ্রামের আদিবাসী প্রধান শান্তি মাণ্ডির বাড়িতে বোমা ছোঁড়ে তৃণমূলীরা। যদিও এদিন সকালে অপরাধীদের না গ্রেপ্তার করে তৃণমূলের কথায় উলটে সেই গ্রাম প্রধান শান্তি মাণ্ডি ও তাঁর স্ত্রীকেই গ্রেপ্তার করে পুলিস। পুলিসের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূলের দাগী দুষ্কৃতীরাই নতুন সরকারের পুলিসের সঙ্গে এখন একসঙ্গে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করছে! গোটা জেলাজুড়েই একাধিক জায়গায় চলছে মারধর, সশস্ত্র হুমকি, জোর করে আত্মসমর্পণ করানোর ঘটনা ঘটছে। ইতোমধ্যেই গোটা জেলায় বহু বামপন্থী কর্মী সমর্থক ঘরছাড়া হয়েছেন। মাওবাদীদের কায়দায় 'গণ-বিচারের' নামে লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা ধার্য করা হচ্ছে। নীরব পুলিস প্রশাসন।

প্রকাশ্যে যুবক খুন বালীতে

নিজস্ব সংবাদদাতা

হাওড়া, ২০শে মে— ফোন করে ডেকে নিয়ে এসে নৃশংসভাবে গুলি করে খুন করা হলো এক যুবককে। শুক্রবার হাওড়ার বালীতে এই ঘটনাটি ঘটে। মৃত যুবক পলাশ দাসের বয়স ৪৫বছর। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ খোলা রাস্তার ওপরেই পাঁচজন অপরিচিত দুষ্কৃতী এই হত্যাকাণ্ড চালায়। বালী থানা এলাকার লিলুয়ায় জি টি রোডের ওপর গোল্ডেন কাঁটার কাছে একটি লোহার কারখানায় পরিচিত কেউ ফোন করে ডেকে নিয়ে আসে পলাশকে। আসামাত্রই পরপর গুলি চলে তাঁর ওপর। বুকে, পেটে গুলি লাগে পলাশের। গুরুতর আহত পলাশকে এরপর লিলুয়ার একটি বেসরকারী নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। এদিকে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বালীতে উত্তেজনা ছড়ায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এলাকায় র‌্যাফ নামে। জানা গেছে, পলাশ দাসের বাড়ি বেলুড়ের রাজেন শেঠ লেনে। মৃত যুবক পলাশের নামেও পুলিসের খাতায় বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবে শুক্রবার রাত পর্যন্ত এই খুনের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

শপথ নিলাম

গৌতম দেব

জমির প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর।

অনেক পণ্ডিতই মনে করেন মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয় উত্থানের পিছনে কয়েকটি কারণের অন্যতম এই জমির প্রশ্ন। আরো ছোট পরিধি‍‌তে ও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব। খানিকটা তার সাথে রাজারহাটকেও জুড়ে দেওয়া যায়।

জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য এতবার, কয়েক বছর ধরে, এত জায়গায় সভা সমাবেশে এবং অবশ্যই রেকর্ডেড সাক্ষাৎকারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে যে তা খুব অল্প সময়ে বঙ্গবাসীর বিস্মরিত হওয়া মুশকিল। পুলকিত বঙ্গবাসীর একাংশ সে কারণে 'সততা', 'সারল্য' এবং বঙ্গ সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ শিরোপা 'সৌজন্যে'র প্রতীক মমতাকে ডালি উজার করে সমর্থন করেছেন। মমতার জমি-নীতির ব্যাঞ্জনায় আমরাও ঈষৎ রোমাঞ্চিত। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষীয়মান। রহস্য উপন্যাসের শেষ অংশের মতো মারকাটারি উত্তেজনা।

নগণ্য মানুষ। ততোধিক নগণ্য তার বুদ্ধি-বৃত্তি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কত কিছুই না তার অজানা! এই যে ভোটে বামফ্রন্ট গোহারা হারবে এটা কি বুঝেছিল এই ছা-পোষা মানুষের দঙ্গল? এই দঙ্গলের একচেটিয়া আধিপত্য শুধু বামপন্থীদের নয়, ডান অথবা মধ্যমবর্গীয়রাও আই কিউ ডেফিজিট এই জনতার অংশীদার। ভোট গণনার আগের রাতেও তৃণমূলের দেবীদাসরা তৃণমূল+কংগ্রেসকে ১৫১ থেকে ১৬৫'র বেশি দিতে অস্থিরচিত্ত ছিলেন। আমজনতার কথা বাদ দিলাম। এথেনীয় গণতন্ত্র থেকে শুরু করে প্লেটো, এরিস্টটল এবং রুশো অথবা স্কামপিটার.....সকলের আবিষ্কৃত সত্য কি মিথ্যা হতে পারে? ভল্টেয়ার কি এমনি এমনি বলেছেন যে মানুষ দুই প্রকারের _ people & People! একটার আগে ছোট অক্ষর আর একটার আগে ক্যাপিটাল লেটার! কিন্তু মর্তধামে আবির্ভূত সেই সব দেবদেবীরাও যদি এক সুরে অন্য কথা বলতেন তাহলে মধ্য ও নিম্ন মেধার আমজনতার পক্ষে সত্য বোঝার একটা দিকনির্দেশ থাকতো। পোস্টাল অ্যাড্রেস বর্তমানে মর্তলোক হলেও যারা প্রকৃত পক্ষে স্বর্গবাসী এবং ক্ষণিকের জন্য এ ধরায় পদার্পণ করেছেন ক্যাপিটাল অক্ষর সামনে নিয়ে চলা তেমনি এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা, এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান ভোটের আবহবার্তা অগ্রিম জানান দেওয়ার পেটেন্ডেড মহাশয়, ভোট গুণতির কয়েক ঘণ্টা আগেও লিখলেন : ''নির্বাচনের আগে গত ছ'মাসে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং কর্মীরা বলেছিলেন, বামপন্থীরা ২০০৯ সালের ধাক্কা সামলে উঠেছেন এবং তাদের বিপুল নির্বাচনী বন্দোবস্ত আবার কাজ শুরু করেছে। তাছাড়া বলা হয়েছিল পার্টি তাদের মারাত্মক ধরনের ভুল ত্রুটিগুলির মধ্যে বেশ কিছু সংশোধন করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রার্থী নির্বাচনও চমৎকার হয়েছে। বামপন্থীদের পুনরুদ্ধারের পক্ষে এগুলি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে হাজির করা হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত স্বশাসিত সংস্থাগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের অযোগ্য পরিচালনার জন্য। বামপন্থীরা সাম্প্রতিক ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনগুলিতে ভালো ফল করেছে। সুতরাং লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিধানসভা নির্বাচনে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং বামপন্থীরা কম পার্থক্য হলেও জয়লাভ করতে পারে।''

ফলে গোল পাকিয়েছে আরো বেশি। শ্রম ও পুঁজির যুগ ছাড়িয়ে জ্ঞানের যুগে প্রবেশ করার পরেও যদি জ্ঞানশ্রেষ্ঠ ''ব্রাহ্মণের'' এই ভুল হয় তাহলে বনগাঁ লোকাল বা রানাঘাট লোকাল কি করতে পারে? স্বর্গলোকেও শ্রেণীভেদ প্রকট। এ সি নিয়েলসন মার্কা দেবতারা এবং মমতা মার্কা দেবীরা অন্তরীক্ষে হাসছিলেন। কারণ সত্য জানার পরশপাথর তাদের করায়ত্ত। এ সি নিয়েলসন যা বলেছে তাই হয়েছে; মমতাও যা বলেছেন তাই হয়েছে। উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার মনিটরিং রুমে বসে ওঁরা সত্যকে রিমোটে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সঠিক স্থানে সত্যকে নিয়ন্ত্রিত মিসাইলের মতো পৌঁছেও দিয়েছেন।







অতীত নিয়ে বড্ড বেশি সময় নষ্ট করে বামপন্থীরা। গতকাল ছাড়ুন, আজ কি হবে বলুন; কাল কি করবেন জানান। আমজনতার নাকি এটাই দাবি—সৌজন্যে ক্যাপিটাল লেটারবৃন্দ। তাই মিডিয়া সন্ত্রাসবাদীরা ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে বলছে, বলো—মমতার আর এক নাম সৌজন্য এবং উদারতা। মা-মাটি-মানুষের স্লোগানের সৃষ্টিকর্ত্রী (যদিও কুজনে বলে স্লোগানটা বাংলাদেশের বেগম জিয়ার থেকে চুরি করা!), মা সারদা, মা টেরিজা, সিস্টার নিবেদিতার বঙ্গভূমে, কালীঘাটে সব মায়ের উপরে অধিষ্ঠাত্রী মহাকালের মায়ের মন্দিরের অদূরে গরিবের পর্ণকুটিরে, কলোনির টালির চালায় মানবমুক্তির যজ্ঞে আত্মাহূতি দিতে আবির্ভূত হয়েছেন সবার 'দিদি' মমতা। ক্ষমা যার রক্তে লোহিত কণার মত সদাই প্রবহমান; সৌজন্য যার চিত্তে অন্তঃসলিলা। তবে দেব দেবীরাও আজকাল অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিনের শিকার। মর্তে ছোট-লেটারের জনগণের সেবায় নিয়োজিত মহৎ এইসব প্রাণগুলিকে আমজনতার ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখা কষ্টসাধ্য। হাই ডোজের স্টেরয়েড ছাড়া দিদির আবার ক্ষমার অর্গল উন্মুক্ত হয় না; সৌজন্যের ফল্গুধারা উদ্দামতা পায় না। শুধুমাত্র নির্বাচনে বিপুল বিজয় অথবা রাজ্যপাট হাতে পাবার ঘটনা—পরিমিত স্টেরয়েড ডোজের শর্তপূরণে ব্যর্থ। জেতা এবং ক্ষমতা পাওয়ার চাইতে বড় ভাবনা ক্ষমতা ধরে রাখা। এখানেই আছে পরিমিত হাই ডোজ স্টেরয়েডের গোপন রহস্য। এটা সেবন করা মাত্র দিদি মাতৃরূপিনী। স্নেহবৎ পার্থকে পাঠান পাম অ্যাভিনিউতে; দিদি জানান দিয়ে সৌজন্যের আজান দেন প্রাক্তন কমিউনিস্ট নেতার বাড়িতে; নিমন্ত্রণপত্রে ভরে ওঠে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। বর্তমানের সঙ্গে প্রাক্তনরাও হয় আমন্ত্রিত। সাঁইবাড়ির খুন হওয়া বাড়ির লোক নিমন্ত্রিত; সাঁইবাড়ি খুনের 'আসামী'ও নিমন্ত্রিত! এ নাহলে দিদি। মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী হিন্দু সমাজে অগুনতি মূর্তির লিস্টে শুক্রবার বারবেলায় একটা একে আর একটি মূর্তি নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর কুমোরটুলি পাড়ায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন একটাই। দিদি কি চশমাটি বাদ দিতে রাজি হবেন। না হলে চশমাওয়ালা মূর্তি মার্কেটিং করতে একবিংশ শতাব্দীতেও কিঞ্চিত অসুবিধা হবে না?



রক্তস্নাত পশ্চিমবাংলা। বামপন্থীরা আর কত রক্ত দেবে? দেশের সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক উপচে পড়তো মানুষগুলোকে খুন না করে রক্তটা সব দান করতে বললে। রক্তাল্পতায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। কিন্তু তবু বাঁচতো অনেকগুলি প্রাণ। অনেকগুলি জ্যান্ত অঙ্গ পাওয়া যেত!!

হয় মরো নয় তৃণমূল করো। নির্বাচনপূর্ব মা-মাটি-মানুষের পরিবর্তে নির্বাচনোত্তর স্লোগান তৃণমূলের এটাই। স্লোগান কার্যকর করার পন্থা এখন পর্যন্ত দুই প্রকারের: মাওবাদী এবং বিমল গুরুঙ-এর গান্ধীবাদ। প্রথম পন্থায় এখন পর্যন্ত দেবীপূজায় বলিদান হয়েছে অনেকগুলি প্রাণ। ত্রিপুরার মহারাজের পশুবলির রক্তস্রোতে বিচলিত কবিগুরু লিখেছিলেন রাজর্ষিতে—এত রক্ত কেন! আজ একবিংশ শতাব্দীতে মূর্তীয়মান মায়ের আগমনীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে এতো মানুষবলির (হোক না ছোট অক্ষরের মানুষ) রক্ত ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর এস এম এসের জন্য প্রতীক্ষিয়মান আমরা।

দ্বিতীয়পন্থা — গুরুঙ-এর গান্ধীবাদ। যে গান্ধীবাদী অহিংসায় সুভাষ ঘিসিঙ পুনরায় পাহাড় ছাড়া। মৃত স্ত্রীর সৎকার পর্যন্ত করার অনুমতি মেলে না যে গান্ধীবাদী অহিংসায়। গ্রাম-শহরে মমতার ভৈরববাহিনী সেই অহিংস্র আন্দোলন শুরু করেছে প্রায় দুই কোটি মানুষের ভোট পাওয়া বামপন্থীদের নীরবে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য। আলোচনার জন্য সস্নেহে ডেকে বলা হচ্ছে — পতাকা ছাড়ো, তৃণমূল করো। নইলে মরো, নিদেনপক্ষে গ্রাম/পাড়া ছাড়ো! কলেজ সংসদ জিতেছো? সে তো বৈদিক যুগে। দিদির যুগে জনমতের সুনামীকে সম্মান জানাতে ইউনিয়নের চাবি হাতে দাও। নইলে স্বপন কোলে হওয়ার জন্য তৈরি হও। নতুন করে ইউনিয়ন করার ঝামেলা নেই, ইউনিয়ন অফিস বানানোর ঝুঁকি পোহানো নেই। শুধু সি আই টি ইউ-র সাইনবোর্ডটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লালঝাণ্ডা নামিয়ে দিয়ে দিদির ছবিওয়ালা বঙ্গ দেশের জাতীয় পতাকা টাঙিয়ে দিলেই হলো। আর লোকগুলো? রামকৃষ্ণ বহুকাল আগেই বলে গেছেন — লোক না পোক!



পরিশেষে মমতাময়ী দিদির শান্তি ধারায় নিস্তরঙ্গ আর সৌজন্যের রামধনুরংচ্ছটায় প্রলম্বিত গোধুলিবেলায় খেয়া পাড়ে নৌকার জন্য অপেক্ষমান ছোট অক্ষরের এক যাত্রীর বড় অক্ষরের একটি প্রশ্ন। 

 ''১৮৯৪ সালের দানবীয় জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী মা-মাটি-মানুষের সরকার কোথাও এক কাঠা জমি নেবে না।''

 ''পশ্চিমবঙ্গে 'সেজ' চলবে না।''

 ''নতুন কৃষি জমি নীতি তৈরি হবে।''

 ''সিঙ্গুরের ঘটনা থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে যে, কোনোরকম শিল্প স্থাপনের জন্য কৃষিজমি দখল করা উচিত নয়। কৃষির ক্ষতিসাধন করে অন্য কোনও উৎপাদনই কৃষকদের অথবা রাজ্যবাসীর পক্ষে লাভজনক হবে না।''

''কোনো জমিই জমির মালিক বা কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অধিগ্রহণ নয়।''

 ''তৃণমূল কংগ্রেস সরকার অবশ্যই শিল্পায়নের জন্য সেই সকল জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করবে যেগুলি আদৌ চাষযোগ্য নয়।''

 ''আমাদের লক্ষ্য হবে জমিহারা মানুষেরা যাতে প্রস্তাবিত পরিকল্পনার সুফলের অংশীদার হতে পারে।''

 ''কোনো অবস্থাতেই বা কোনো অজুহাতেই সরকার জমি ও আবাসন ব্যবসার জন্য কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে জমি অধিগ্রহণ করবে না।''

 ''পশ্চিমবঙ্গের ৫৬ হাজার বন্ধ কারখানার ৪৪ হাজার একর জমিতে হয় আগের কারখানার পুনর্জীবন, নয়তো নতুন কারখানা করার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থাৎ, 'শিল্পের জমিতে শিল্প' — এই নীতিতে কাজ হবে।''

 ''আদর্শগতভাবে আমরা এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত বা জমিচ্যুত কৃষকদের প্রস্তাবিত পরিকল্পিত শিল্পোৎপাদনের লভ্যাংশের ভাগীদার করার বিষয়টি বিবেচনা করবো।''

 ''শিল্পের জন্য জমিকে শিল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে। যাতে সেই জমি কোনো পরিস্থিতিতে রিয়েল এস্টেটের জন্য ফাটকাবাজিতে ব্যবহার করা না হয়।''

উপরিউক্ত বাক্যগুলি সমস্তই মমতাদেবীর নেতৃত্বে পরিচালিত তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশ্‌তেহার থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো। শুধু একথা নয়া মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-রাজারহাটের সোপান পেরিয়ে আজ আপনি মহাকরণের অলিন্দে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলা আর কোনো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-রাজারহাট চায় না। মানুষের একটা বড় অংশের রায়-ও তাই। মানুষের রায় থেকে শিক্ষা আপনি নেবেন, আমরাও নেবো। বিরোধী দলের কাছ থেকেও সরকারী দলের অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সর্বশেষ সৌজন্যের শান্তিনিকেতনীয় আদব কায়দা সমেত।

শপথ নিলাম — বাংলার স্বার্থে, দে‍‌শের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সৌজন্যের স্বার্থে আপনার শিক্ষা আপনাকে সময়মতো ফেরত দেবো। রোজ শহীদের লাশ বহন করতে করতে আমরা খানিকটা ক্লান্ত। শপথ নিলাম পথের ধারে, ঝোপের ধারে, পুকুরপাড়ে পড়ে থাকা শহীদবন্ধুদের মৃতদেহগুলি তাঁদের প্রিয়জনদের কাছে লালপতাকায় ঢেকে পৌঁছে দেবো। আর মিথ্যার তমানিশা এবং ধুম্রজাল ছিন্নভিন্ন করে লাল সকালের চির প্রতীক্ষায় শুধু বসে থাকবো না, সূর্যোদয়ের সময় নির্ঘণ্টও পাল্টে দিয়ে ঊষালগ্ন এগিয়ে আনবে বাংলার লাখো কোটি জনগণ। সামনে থাকবে লাল পতাকা।

শপথ নিলাম — দেখা হবে সংগ্রামের রাজপথে।

অর্থনীতি নিয়ে বেহাল প্রচার

বিগত বেশ কয়েকমাস ধরেই রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে একটা নেতিবাচক প্রচার চলছে। নির্বাচনী প্রচারের সময়, বিশেষ করে তৃণমূল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই প্রচারে বাড়তি গুরুত্ব দেয়। তৃণমূলের এই প্রচারকে মিডিয়ার একাংশ অতিরঞ্জিত করে এমন এক বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করে যাতে মনে হতে পারে সত্যি সত্যি রাজ্যের অর্থনীতি গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের অর্থনীতির হাল এতটাই খারাপ করে দিয়েছে যে এখন কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও সম্ভব হবে না। নির্বাচনী প্রচার শেষ হবার পর তৃণমূলের পক্ষ থেকে এই প্রচারের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তখন এই প্রচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কাঁধে তুলে নেয় মিডিয়ার একাংশ, বিশেষ করে আনন্দবাজার পত্রিকা। এই বাজারী কাগজটি বামবিরোধী তথাকথিত অর্থনীতিবিদদের দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে রাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা সত্যি সত্যিই বেহাল। মনগড়া তথ্য হাজির করে এবং তার ভ্রান্ত বিশ্লেষণ করে একপেশী সিদ্ধান্ত খাড়া করে এমন ধারণা ছড়াতে চাইছে যে, এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তৃণমূল যখন জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা তখন বাজারী পত্রিকা বলছে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নাকি 'বঙ্গ-টিম' তৈরি করেছেন।

অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব সাধারণ মানুষের সবসময় বোধগম্য হয় না। একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থনীতির হালচাল উপলব্ধিতে রাখা অনেকটা আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর রাখার মতো। তথাপি প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের একটা অর্থনীতি আছে। সেই সুবাদে রাজ্য বা দেশের অর্থনীতির হালচাল সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা করেন। নির্বাচনের আগে বিরোধীদের প্রচার এবং পরে বাজারি পত্রিকার পরিকল্পিত প্রচার সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞানকে গুলিয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বামপন্থীরা বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত একাধিকবার যুক্তি-তথ্য দিয়ে সহজসরলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের অর্থনীতি সম্পর্কে আসলে যা প্রচার হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। প্রচারে সবচেয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে ঋণের ওপর। এক একজন এক এক তথ্য হাজির করে বলার চেষ্টা করছে রাজ্য নাকি গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে আছে। কোষাগারের হাল নাকি এতটাই খারাপ যে কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও সম্ভব হবে না। 

যারা এইসব প্রচার করছে তারা অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলিকে আড়াল করে শুধু কিছু সংখ্যা-তথ্য হাজির করে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। বোঝানো হচ্ছে ঋণ মানেই খারাপ। কিন্তু আড়াল করা হচ্ছে ঋণ যে বিকাশমান অর্থনীতির প্রধান অঙ্গ সেই সত্যকে। একজন বেকার যুবক ঋণ নিয়ে অটো কিনে রোজগার করে সংসার চালায় এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধি করে। ঋণ নিয়ে বাড়ি বানিয়ে পরে বাড়ির মালিক হয়। ঋণ নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে স্বচ্ছল জীবন গড়ে তোলে। তেমনি বিশ্বের সব বাণিজ্যিক সংস্থা এবং সব সরকার ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ায় ও উন্নয়ন করে। ঋণ ক্ষতিকারক নয় বরং সুবিধার উপাদান। কেন্দ্রীয় সরকার এবং সমস্ত রাজ্য সরকারেরই বিপুল ঋণ আছে। দেখতে হবে ঋণ শোধ করার সামর্থ আছে কিনা। পশ্চিমবঙ্গের সেই সামর্থ আছে। বামফ্রন্টের আমলে ধারাবাহিক উন্নতি রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের আয় বাড়ছে সাথে সাথে ব্যয়ও বাড়ছে। তাই অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানোর দরকার নেই। তথাপি আতঙ্ক ছড়ানোর অন্য উদ্দেশ্য আছে। নতুন সরকারকে মহিমান্বিত করতে হলে পুরনো সরকারকে খারাপ প্রমাণ করতে হবে। রাজ্যকে দেউলিয়া বলে প্রচার করলে নতুন সরকারকে গোড়া থেকে সফর প্রচার করা সহজ হয়। তাই বাজারী পত্রিকা রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে এতটা মরিয়া।

তৃণমূলের সৌজন্য

তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যের অর্থ হলো সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা শেখ ইসরাইলকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা। তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যের অর্থ হলো, সি পি আই (এম) কর্মী হওয়ার অপরাধে দুর্গাপুরে কৃষক দম্পতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা। তৃণমূলের সৌজন্যের শিকার হয়েছেন চোপড়ার খেতমজুর এবং পার্টি সমর্থক দহিরুদ্দিন। তৃণমূল তাদের সৌজন্য দেখাতে হত্যা করেছে গড়বেতায় সি পি আই (এম) নেতা জীতেন নন্দী এবং শালতোরায় অজিত লোহারকে। তৃণমূলের সৌজন্যে প্রাণ হারাতে হয়েছে রায়নার পূর্ণিমা বাড়ুইকে। তৃণমূল দুষ্কৃতীরা তাদের সৌজন্য দেখাতে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে পার্টি সমর্থক পরিবারের মহিলা, শিশুদের ওপর। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে নতুন সরকার শপথ নিয়েছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে বিজয় উৎসব চলছে। ঐ বিজয়োল্লাসের নামে হামলা, নিগ্রহ, জরিমানা আদায় ও ঘরছাড়া করা হচ্ছে। এই সৌজন্যই দেখাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলী বাহিনী হামলা চালাচ্ছে সি পি আই (এম) নেতা ও সমর্থকদের বাড়ি। সাজানো অস্ত্র দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অনেক পার্টিকর্মীকে। অস্ত্র তল্লাশির নামে পার্টি অফিসগুলি তছনছ করা হচ্ছে। তৃণমূলের রাজনৈতিক ও বেআইনী দাবি মেনে নিয়ে পুলিস কোনোরকম পরোয়ানা ছাড়াই যেখানে খুশি তল্লাশি চালাচ্ছে। সরকারী ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস চালানোই তৃণমূলের সংস্কৃতি ও সৌজন্য।

নির্বাচনের আগেও তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক সৌজন্যের পরিচয় দেয়নি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা, শিল্প প্রকল্প প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল ঐ বৈঠকে যোগ দেওয়ার সৌজন্য দেখায়নি।। বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে সেখানে যোগ দেয়নি তৃণমূলের কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ বা বিধায়ক বরং বিধানসভার মধ্যে ভাঙচুর করে অসভ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তৃণমূলের বিধায়করা। অশালীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের। রেলের একটি অনুষ্ঠানেও ডাকা হয়নি কোনো বাম বিধায়ক বা মন্ত্রীকে। এমনকি রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতেও রেলের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অতীত ও বর্তমান থেকে স্পষ্ট যে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পর আনুষ্ঠানিক সৌজন্য দেখানোর পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক চাল। এই তথাকথিত সৌজন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সততার কোনো সম্পর্ক নেই। মিডিয়ার সাহায্যে মানুষকে চমক দেওয়াই এই সব সৌজন্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বামপন্থীরা ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতিকে অনুসরণ করেন। এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েই বামপন্থীরা কাজ করবে। শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকার গঠন একটি সাংবিধানিক প্রথা। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নি‍‌য়েছে বামপন্থীরা। কিন্তু সৌজন্যের বড়াই করার কোনো নৈতিক অধিকার তৃণমূলের নেই। বিরোধীপক্ষে থাকাকালীন তৃণমূল রাজনৈতিক শিষ্টাচার মানেনি। ভোটের পরেও তৃণমূলের নেতৃত্বেই বিরোধী বামপন্থীদের ওপর আক্রমণ চলছে। যারা সৌজন্য বা শিষ্টাচারের পরোয়া করে না তাদের মুখে এসব কথা আদৌ মানায় না। তৃণমূল কিংবা তাদের হয়ে যাঁরা ওকালতি করেন তাঁরা শিষ্টাচার বা সৌজন্য নিয়ে যত কম উপদেশ দেবেন ততোই ভালো।

সৌজন্যের নমস্কারে জিতলেন মমতাই

অনিন্দ্য জানা • কলকাতা

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ?

আদিগন্ত গণ-উন্মাদনা?

শপথের পর রাজভবন থেকে মনুষ্যসাগরে ভাসতে ভাসতে মহাকরণ? যে লালবাড়ি থেকে ১৮ বছর আগের এক বিকেলে তাঁকে চুলের মুঠি ধরে বার করে দেওয়া হয়েছিল!

নাহ্‌!

সম্ভবত এর কোনওটাই নয়।

রাজভবনের লনে বিশাল শামিয়ানার তলায় সময় থমকে গেল ওই কয়েকটা সেকেণ্ডে। যে কয়েকটা মুহূর্ত বহির্জগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত। নীরব। অথচ অসম্ভব বাঙ্ময়। ঔপচারিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে অনন্ত।

রাজ্যে (এবং বিশ্বেও) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত দীর্ঘতম কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ আগেই। শুক্রবার দুপুরে তা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা পেল। যখন রাজ্যপালের পাশে দাঁড়িয়ে সবুজে এবং রজনীগন্ধায় মাখামাখি গম্ভীর মঞ্চে অনুচ্চ এবং আটপৌরে শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চপ্পলের মহিলা পড়লেন, 'পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে...'। ঝিকিয়ে উঠল সার সার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাল্‌ব। তাক করল দৃশ্য ক্যামেরার লেন্স। ঝোড়ো হাততালির শব্দ উঠল চারদিকে। 'ইতিহাস' তৈরি হয়ে গেল।

সাধে কি আর ইউপিএ সরকারের তরফে হাজির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম কলকাতা ছাড়ার আগে বলে গেলেন, "এ এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই মুহূর্তটি পশ্চিমবঙ্গে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। যার জন্য এ রাজ্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে!"

মুখোমুখি। শপথের আগে মঞ্চে ওঠার মুখে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে নমস্কার বিনিময়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শুক্রবার রাজভবনে। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

চিদম্বরম রাজনীতির লোক। তিনি তো এমন বলবেনই। যেমন বলবেন রাজনীতির অন্য কারবারি এবং বাম-বিরোধী কোটি মানুষ। কিন্তু রাজ্যে পট পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে জীবনের ক্যানভাসে সম্ভবত শাশ্বত এবং আবহমান মুহূর্ত তৈরি হল তার কয়েক মিনিট আগে। মঞ্চের নীচে।

যখন মুখোমুখি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কোনও বাক্য বিনিময় হল না। কিন্তু গত কয়েক দশকের (বা, গত পাঁচ বছরের) পুরনো রোখাচোখা মনোভাবও দেখা গেল না। থমকে-দাঁড়ানো কয়েক লহমায় বিজয়িনী এবং বিজিতের মধ্যে একটা নীরবতা ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে রইল বটে (হয়তো দু'জনেরই মনে পড়ে থাকবে, এই রাজভবনেই তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর মধ্যস্থতায় সিঙ্গুর-আলোচনার কথা। যা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছিল)। কিন্তু খুব একটা অভাব দেখা গেল না সৌজন্য এবং প্রতি-সৌজন্যের (নাকি, কিছুটা দেখাও গেল?)।

তবু তার মধ্যেই রচিত হল রাজ্যে 'পরিবর্তন'-এর পটভূমিতে গভীর, গভীরতম মুহূর্ত। যখন একে অপরের কয়েক ফুটের মধ্যে রইলেন এত দিন দুই শিবিরের যুযুধান দুই সেনাপতি। প্রথম জন কয়েক মিনিটের মধ্যে ভার নেবেন বাংলার। দ্বিতীয় জন গণরোষে রাজ্যপাট খুইয়ে নিছকই এক নেতা-নাগরিক। হয়তো খানিক বিড়ম্বিত। এবং মমতার স্বভাবজ রাজনৈতিক সৌজন্যের সামনে কিছুটা নিরুপায়ও।

প্রথমে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে এবং তার পর পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে মমতা এ রাজ্যের আবহে যে সৌজন্য-ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে নেমেছিলেন, এ দিন তা পৌঁছল তুঙ্গ মুহূর্তে।

ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসুদের সময়টা মনে রাখা উচিত— ২০ মে, দুপুর ১২টা ৫৭ মিনিট।

তার কিছু ক্ষণ আগে, বেলা পৌনে ১টা নাগাদ শামিয়ানার তলায় এসে পৌঁছেছেন বুদ্ধবাবু। তত ক্ষণে চলে এসেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এসেছেন বাম শরিক দলের নেতা ক্ষিতি গোস্বামী, বিশ্বনাথ চৌধুরী, নরেন চট্টোপাধ্যায়, বরুণ মুখোপাধ্যায়, মঞ্জুকুমার মজুমদার, কিরণময় নন্দ, প্রতিম চট্টোপাধ্যায়রা (তাঁরা অবশ্য ভিড়ের আবডালেই রয়ে গেলেন)। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং প্রাক্তন মন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন (সস্ত্রীক আসার অনুরোধ করলেও স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে অবশ্য নিয়ে আসেননি বুদ্ধবাবু), সেই পার্থবাবু এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তার পর অতিথি-আদর করে বসিয়ে দিলেন সোফায়। এক পাশে বিমানবাবু। অন্য পাশে অসীমবাবু। বিমানবাবুর পাশে বিধানসভার প্রবীণতম সদস্য কংগ্রেসের জ্ঞানসিংহ সোহনপাল। তাঁর পাশে পরপর তৃণমূলের দুই সিনিয়র সাংসদ সোমেন মিত্র এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদীপবাবুর পাশে বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম। রয়েছেন প্রাক্তন রাজ্যপাল বীরেন জে শাহ-ও।

শুভেচ্ছা

প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদম্বরমের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। -দেশকল্যাণ চৌধুরী

শামিয়ানার নীচে ভিড় জমছে। আসছেন গ্ল্যামারজগতের নক্ষত্ররা। প্রসেনজিৎ, রঞ্জিৎ মল্লিক, মমতাশঙ্কর, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, কোয়েল মল্লিক, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, জুন মাল্য, রূপম ইসলাম, সুপ্রিয়া দেবী, দীপঙ্কর দে, গৌতম ঘোষ, হারাধন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ, সন্ধ্যা রায়, হরনাথ চক্রবর্তী, নচিকেতা চক্রবর্তী, সৌমিত্র রায়রা।

রয়েছেন পরিবর্তন-পন্থী বিশিষ্টজনেরা। শুভাপ্রসন্ন (যাঁর পরামর্শে শপথগ্রহণের মঞ্চে সম্ভবত এই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত হল। 'নাই নাই ভয়..'-এর নিহিত অর্থ, বিখ্যাত চিত্রকরের কথায়, "একটা লড়াই জেতা হয়েছে। কিন্তু সামনে সরকার চালানোর মতো আরও কঠিন লড়াই। সেটাতেও জয় পেতে হবে"), মহাশ্বেতা দেবী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সুনন্দ সান্যাল, বিভাস চক্রবর্তী, শাওলি মিত্র, প্রতুল মুখোপাধ্যায়রা।

ছিলেন শিল্পোদ্যোগীরা। হর্ষবর্ধন নেওটিয়া, জি পি গোয়েন্‌কা, সঞ্জয় বুধিয়া, এস কে রায় প্রমুখ। রয়েছেন কলকাতাস্থিত বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের কূটনীতিকরাও।

বেলা ১টার কয়েক মিনিট আগে ঢুকলেন মমতা। চিরকালীন শশব্যস্ত পায়ে। পিছন পিছন রেলের নিরাপত্তারক্ষীরা। একটা তরঙ্গ তৈরি হল চারপাশে। আপনা থেকে তৈরি হয়ে গেল একটা আলোর বৃত্ত।

মমতার একটা দীর্ঘলালিত অভ্যেস আছে। যেটা এত দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোক হলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণে দেখা যেত। অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকেই মঞ্চের সামনে একেবারে প্রথম সারিতে বসা ভিভিআইপি অভ্যাগতদের সামনে ত্বরিত পায়ে হেঁটে আসতে আসতে মাথা ঝুঁকিয়ে জোড় হাতে তাঁদের নমস্কার করছেন মমতা।

এ দিন সেই দৃশ্য নেমে এল রাজভবনে।

একেবারে প্রথমে অসীমবাবু। ঝটিতি নমস্কার মমতার। তার পরেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী!

ঈষৎ শ্লথ হল নতুন মুখ্যমন্ত্রীর গতি। সোফায় হেলান-দেওয়া বুদ্ধবাবুর দিকে সামান্য ঝুঁকে জোড়হাতে নমস্কার করলেন মমতা। তালুর ফাঁকে সবুজ রংয়ের একটা কলম আর 'প্রোগ্রেসিভ লেন্স'-এর চশমাটা। বুদ্ধবাবু স্থাণু। সম্ভবত খানিকটা বিহ্বল। দ্বিতীয় নমস্কার। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তখনও কোনও বিচলন নেই।

এই সময়ে আদর্শ হতে পারত বুদ্ধবাবুর উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি নমস্কার। সামনে যিনি এসে জোড়হাতে দাঁড়িয়েছেন, প্রথমত, তিনি মহিলা। দ্বিতীয়ত, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ নেত্রী। কিন্তু খানিকটা জড়সড় হয়ে নিজের আসনেই বসে রইলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী! খানিকটা দৃষ্টিকটূ ভাবেই (হতে পারে মমতা তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু তাঁর 'পদ' তো রাজ্যে শীর্ষতম। তবে বুদ্ধবাবুর ওই প্রতিক্রিয়া বোধহয় তাঁর পরিপার্শ্বের আশ্চর্য বদল দেখে! যে শিল্পপতি যোগী দেবেশ্বর তাঁকে একদা দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী বলে বর্ণনা করেছিলেন, তিনিই তাঁর কয়েক ফুটের মধ্যে দাঁড়িয়েও মোবাইলে ব্যস্ত রইলেন)।

অস্বস্তিকর নিঝুম চারদিক।

তৃতীয়বার মাথা ঝুঁকিয়ে পূর্বসূরিকে নমস্কার করলেন মমতা। এত ক্ষণে সম্ভবত সম্বিত ফিরল সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির। সোফার ব্যাকরেস্ট থেকে পিঠটা সোজা করে খানিকটা উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করলেন তিনি। সামনে বাড়ানো দু'হাত উঠল প্রতি-নমস্কারের মুদ্রায়।

এবং মমতা সটান তাকালেন চশমার আড়ালে বুদ্ধবাবুর চোখের দিকে। দৃষ্টিতে অসম্ভব এক আবেগ এবং তেজ মিলেমিশে একাকার। সম্ভবত অনুচ্চারিত বক্তব্য: 'আমি পেরেছি'। আর তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত হাসির বিচ্ছুরণ। কিন্তু সে হাসিতে কোথাও পূর্বসূরিকে ছোট করার বাসনা নেই। বরং রয়েছে সৌজন্যের গরিমা।

বিপুল জয় সম্ভবত মানুষকে অনেক উদার করে। করে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসীও। এবং তৈরি করে এমনই সব মায়াবি বিভ্রম।

দলীয় সাংসদদের মৃদু হাসি দিয়ে মমতা এগোলেন হাসিম আব্দুল হালিমের দিকে। নমস্কারের জবাবে ডান হাতটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বয়ঃকনিষ্ঠ রাজনীতিকের মাথায় রাখলেন প্রাক্তন স্পিকার। পরের সোফায় পৌঁছে মমতা আরও ঝুঁকলেন। পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন মহাশ্বেতা দেবী এবং অমলাশঙ্করকে।

এর পরেই মমতা উঠবেন মঞ্চে। শুরু হয়ে যাবে ফলিত স্তরে 'পরিবর্তন'। টানা আড়াই ঘণ্টা সেই প্রক্রিয়া বসে দেখবেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দৃষ্টি কখনও নিবদ্ধ থাকবে মঞ্চের উপর রাজ্যপালের পাশে গদি-আঁটা চেয়ারের দিকে। যেখানে বসে কখনও মৃদু হাসছেন, কখনও অধৈর্য হচ্ছেন, কখনও মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন দেখবেন এবং সম্ভবত ভাববেন, নতুন উপাস্য এসে গিয়েছেন। চুল্লিতে উঠে গিয়েছে সাড়ে তিন দশকের বাম-শাসন। বেরিয়ে আসছে প্রাক্তনের ছাই।

শপথ অনুষ্ঠান শেষে পুলিশ-ব্যাণ্ডে শুরু হল জাতীয় সঙ্গীত। সটান দাঁড়িয়ে সকলে। মঞ্চে মমতা বিড়বিড় করে গলা মেলাচ্ছেন 'জনগণমন অধিনায়ক...'। মঞ্চের নীচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ব্যাণ্ড নীরব হওয়ার পর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ডান দিকে ঘুরে রওনা দিলেন বাইরে-রাখা গাড়ির দিকে। দু'পাশে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে-হাতে ব্যারিকেড। প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল। আপাত-চেনা গলায় নিজের নামটা শুনেও ডাইনে-বাঁয়ে চোখ সরল না তাঁর। দৃষ্টি সোজা। পাথুরে, আপাত-ভাবলেশহীন মুখ। তিনি এগোলেন পাকাপাকি ভাবে প্রাক্তনের পথে।

মঞ্চের অন্য দিক দিয়ে তখন রাজ্যপালের চা-চক্রে চলেছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। পিছু পিছু দৌড়োচ্ছে এক এলাহি ভিআইপি-জনতা।

ওই কয়েক মুহূর্ত তখনও জীবন্ত রয়ে গেল। আবহমান। শাশ্বত।

সিঙ্গুরের চারশো একর ফেরত দেওয়াই মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

পাঁচ বছর আগে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল রাজ্যে টাটাদের ছোট গাড়ির কারখানা গড়া। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০০৭ সালে সিঙ্গুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে হাজার একর জমি নেওয়া হয়। রাজ্যে 'পরিবর্তনের' হাওয়া তুলতে যে অধিগ্রহণের 'অবদান' অসীম।

শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হল, সিঙ্গুরের 'অনিচ্ছুক' চাষিদের ৪০০ একর জমি 'আইন মেনেই' ফেরত দেওয়া হবে। নতুন সরকারের এই ঘোষণা সিঙ্গুর-কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক বৃত্ত সম্পূর্ণ করল বলা চলে।

এ দিন তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পরে ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, "সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরত দেওয়া হবে। রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। টাটাবাবু (রতন টাটা) চাইলে বাকি ৬০০ একরে কারখানা করতে পারেন।" তবে সিঙ্গুরের জমিতে কারখানা করার জন্য তিনি যে টাটা গোষ্ঠীকে নিজে থেকে আমন্ত্রণ জানাবেন না, তা-ও পরিষ্কার করে দেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী।

নতুন কুর্সি। নতুন দায়িত্ব। মহাকরণে নিজের ঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার।— অশোক মজুমদার

সিঙ্গুর নিয়ে উত্তাল আন্দোলনের দিন থেকেই 'অনিচ্ছুক' চাষিদের জমি ফেরতের দাবিতে অনড় মমতা। এ নিয়ে ধর্মতলায় টানা ২৬ দিন অনশন করেছেন তিনি। ২০০৮ সালে পুজোর আগে সমমনোভাবাপন্ন বিভিন্ন দলকে নিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ২১টি মঞ্চ বেঁধে ধর্নায় বসেছেন। সেই ধর্না তুলতে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল গাঁধীর উদ্যোগে রাজভবনে তৃণমূলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের। 'চুক্তি'-ও হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি কার্যকর হয়নি। এর পরেই ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর ছেড়ে গুজরাতের সানন্দে চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে টাটা গোষ্ঠী।

সিঙ্গুরের জমি টাটাদের ৯০ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। টাটা গোষ্ঠীর বক্তব্য, সেখানে তাদের পরিকাঠামো তৈরির কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ন্যানো গাড়ির মূল কারখানার সঙ্গে যে ৫৪টি সহযোগী সংস্থার কারখানা তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে ৩০টিই প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫০০ কোটি টাকা। সিঙ্গুর প্রকল্প বাতিল হওয়ার পরে রাজ্য সরকার যখন জমি ফেরত চায় তখন টাটারা বলেছিল, লগ্নি করা অর্থ ফেরত দিলে তারা জমি ফেরত দিতে রাজি। কিন্তু সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কিছু হয়নি।

বামফ্রন্ট সরকারের বক্তব্য ছিল, টাটাদের কাছ থেকে জমি ফেরত পেলেও তা চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আইনগত অসুবিধা আছে। এ দিন মমতার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পরে একই প্রশ্ন তুলেছে তারা। ভোটে হারার পরে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব মমতার উদ্দেশে বলেছিলেন, "আশা করব, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়া সংক্রান্ত ফাইলটিতেই প্রথম সই করবেন।" মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত জানার পরে এ দিন তিনি বলেন, "এ হল ঘোড়ার আগে গাড়ি যাওয়ার মতো ঘটনা। মন্ত্রিসভায় কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত করতে গেলে আগে আইন দফতরের সম্মতি লাগে। এটাই নিয়ম। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পরে আইনের সংস্থান দেখা হয় না। এর পরে আইন দফতর প্রশ্ন তুললে মন্ত্রিসভার ওই সিদ্ধান্ত হাস্যকর হয়ে যাবে!"

মমতা অবশ্য জমি ফেরতের ক্ষেত্রে আইনি অসুবিধাকে কোনও গুরুত্ব দিতে চাননি। এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কী ভাবে ওই জমি ফেরত দেবেন? তাঁর জবাব, "সে ভাবতে হবে না। আইন মেনেই জমি ফেরত দেওয়া হবে।"

প্রসঙ্গত, সিঙ্গুর নিয়ে এখন সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। জনস্বার্থে ওই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে কি না, মোট আটটি মামলার মূল প্রতিপাদ্য তাই। সরকারি সূত্রে খবর, প্রতিটি মামলারই শুনানি শেষ। এখন শুধু রায় ঘোষণা বাকি।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো আইনের পথে ৪০০ একর জমি ফেরত দেওয়া যাবে কি না, নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে এটাই শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রথম বিতর্কের জন্ম দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রথম প্রতিশ্রুতি

5_6e সিঙ্গুরে ৪০০ একর ফেরত, বাকিতে শিল্প। টাটারাও স্বাগত
5_6e সাচার-সুপারিশ মেনে সংখ্যালঘু উন্নয়ন। তাঁকে রাজ্যে আনার চেষ্টা
5_6e রাজবন্দিদের মুক্তি নিয়ে দশ জনের কমিটি
5_6e দার্জিলিং নিয়ে বৈঠক শীঘ্রই
5_6e জঙ্গলমহলের উন্নয়নে জোর
5_6e উত্তরবঙ্গের জন্য পৃথক মুখ্যমন্ত্রী-সচিবালয়
5_6e একশো দিনের কাজ, বিপিএল কার্ডের জন্য আলাদা বিভাগ
5_6e বন্যা নিয়ন্ত্রণে কমিটি, বন্যার জল দিয়ে সেচের চেষ্টা
5_6e বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার
previous story

চা-চক্র শেষেই বসলেন রাজ্যপালের সঙ্গে

জয়ন্ত ঘোষাল • কলকাতা

ক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। তাই তৃণমূল কর্মীদের প্রবল উৎসাহে দাবি উঠেছিল, নতুন সরকার শপথ নিক ব্রিগেড ময়দানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই পথেই ভাবছিলেন। কিন্তু জয়ের পর তাঁর দূত পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বলেন, "এ তো রাজনৈতিক দলের শপথ গ্রহণ নয়। বিপুল ভোটে জিতে এখন তো প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য শপথ গ্রহণ। তাই আমার ইচ্ছা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান রাজভবনেই হোক।" মমতা কিন্তু রাজ্যপালের বক্তব্য জানার সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নেন।

যদিও বিতর্কের অবকাশ ছিল, ভোটযন্ত্রে বিপুল ভাবে সমর্থনের বোতাম টিপে প্রশাসনের দায়িত্বভার যাঁরা দিয়েছেন সেই 'মা-মাটি-মানুষের' সামনে শপথ গ্রহণ তো অপ্রাসঙ্গিক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেত লালুপ্রসাদ যাদব, প্রফুল্ল মহন্ত বা মুলায়ম সিংহ যাদবের নাম। বিহার-জয়ের পরে লালু শপথ নিয়েছিলেন পটনার গাঁধী ময়দানে, অগপ নেতা প্রফুল্ল নিয়েছিলেন গুয়াহাটির উন্মুক্ত স্টেডিয়ামে আর মুলায়ম গোমতী নদীর তীরে। এবং নারায়ণনও বলেছিলেন, ভাবী মুখ্যমন্ত্রী যদি শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডকেই বেছে নেন, তা হলে তিনি 'না' করবেন না। কিন্তু রাজ্যে নিজের প্রশাসনিক ইনিংস শুরু করার ক্ষেত্রে মমতা প্রথমেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। রাজ্যপাল যা চাইছেন, মেনে নিলেন। মমতা মানেই বিরোধিতার রাজনীতি— এই ধারণার কথা যাঁরা প্রচার করেন, প্রথম দিনই তাঁদের থামিয়ে দিলেন তিনি।

রাজ্যপালের সঙ্গে যে নতুন মুখ্যমন্ত্রী তালমিল রেখে চলতে চাইছেন, এই ঘটনা থেকেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্কটাকে আরও জোরদার করতে শপথ গ্রহণের পরেই নারায়ণনের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করলেন মমতা।

রাজ্যপালের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন মমতা। — দেশকল্যাণ চৌধুরী

এ দিন শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে রাজভবনের যা পরিস্থিতি, তাতে রাজ্যপাল কিন্তু বলেছিলেন, বৈঠক আগামিকালও হতে পারে। কিন্তু মমতাই জোর করেন। বলে ওঠেন, আমরা তো আজই বসতে পারি। তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, নেত্রী আসলে সাড়ে চারটের আগে মহাকরণে ঢুকতে চাইছিলেন না। তবে কারণ যা-ই হোক, রাজ্যপালের সঙ্গে একান্ত বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে রাজ্যপালকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি প্রশাসনকে রাজনীতি-মুক্ত রাখতে চান। একই সঙ্গে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই তিনি চটজলদি কিছু করে দেখানোর পক্ষপাতী নন। প্রথম সাত দিন সময় তিনি চাইছেন সব কিছু বুঝে নেওয়ার জন্য। সমস্ত বিভাগীয় সচিবের কাছ থেকে তিনি রিপোর্ট চেয়েছেন। সোমবারের মধ্যে সেই রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। রাজ্যপালকে এ কথাও জানান মমতা। আরও বললেন, রাজ্যের আমলাদের রদবদলের ক্ষেত্রেও। ধীরে সুস্থে, সামগ্রিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই চান সিদ্ধান্ত নিতে। রেলভবনে তাঁর ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি) গৌতম সান্যালকে যে মমতা রাজ্যে নিয়ে আসছেন, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। গৌতমবাবু তাঁর সঙ্গে মহাকরণে রয়েওছেন।

রাজ্যপালকে মমতা আরও জানান, গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শিক্ষা থেকে পুলিশ-প্রশাসন, সর্বত্র দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তা তিনি ভাঙতে চান। রাজ্যপাল এ ব্যাপারে সব রকম সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যপালের ভূমিকার যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেটা মেনে নিয়েও মমতা মনে করেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী ব্যক্তি হিসেবে রাজ্যপাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। তাই তিনি রাজ্যপালকে আজ জানিয়েছেন, প্রত্যেক সপ্তাহে এক বার তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করবেন। রাজ্যপাল ক'দিন আগেও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন এবং তার আগে দীর্ঘদিন ছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধান। নিরাপত্তা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে তাঁর সেই পারদর্শিতাকেও কাজে লাগাতে চান মমতা। তিনি মনে করেন, বাম সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট কাজে লাগায়নি।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতার অগ্রাধিকারের তালিকায় এমন অন্তত দু'টি বিষয় আছে, যেখানে নারায়ণনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। যেমন জঙ্গলমহল। রাজ্যপালকে মমতা জানিয়েছেন, মাওবাদের নামে রাজনৈতিক হিংসাকে বরদাস্ত করা হবে না। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, মাওবাদীদের মোকাবিলার নামে সিপিএম যে সব 'হার্মাদ শিবির' তৈরি করেছিল, সেগুলিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা দরকার। তাঁর বক্তব্য, সিপিএম যতই প্রচার করুক, শেষ পর্যন্ত মাওবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতো প্রার্থী হয়ে তৃণমূলের বিরোধিতা করায় স্পষ্ট হয়ে গেল, মাওবাদীদের সঙ্গে কোনও আঁতাঁত নেই তৃণমূলের। মুখ্যমন্ত্রী গোটা বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সবিস্তার আলোচনা করতে চাইছেন।

মাওবাদী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী কৌশল নিতে চান মমতা। এক দিকে যেমন কঠোর হাতে হিংসার মোকাবিলা করতে চান, অন্য দিকে তেমনই বিপথগামী মাওবাদী যুবকদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরিয়েও আনার কথাও মাথায় রাখছেন। পূর্ণেন্দু বসুকে পূর্ণমন্ত্রী করার মাধ্যমে তিনি এই নিয়ে একটি সদর্থক বার্তাও দিয়ে রাখলেন তিনি। আজ এই নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সবিস্তার আলোচনার সুযোগ না থাকলেও রাজ্যের সাম্প্রতিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জেলায় জেলায় অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। রাজ্যপালও জানিয়েছেন, প্রচুর অস্ত্র পশ্চিমবঙ্গে জমা হয়েছে। সে সবগুলিই উদ্ধার করা প্রয়োজন। এবং এটা করা হবে দল নির্বিশেষে।

আর একটি বিষয় হল পাহাড়। এ দিন শপথ অনুষ্ঠানে রোশন গিরিরা এসেছিলেন। রাজ্যপালের সঙ্গে চা খেতে খেতে মমতা যখন সকলের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন তাঁরা গিয়ে দেখাও করেন। বস্তুত, বিমল গুরুঙ্গ আগেই বলেছেন, তিনি মমতার সঙ্গে বসতে আগ্রহী। মোর্চা প্রধানের সঙ্গে ট্র্যাক টু কূটনীতির ধাঁচে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে তৃণমূলের পক্ষ থেকে। মমতা কিন্তু কঠোর হাতেই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে চান। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, পৃথক গোর্খাল্যাণ্ড তিনি হতে দেবেন না। তবে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি তিনি বিবেচনা করে দেখতে পারেন। কেন্দ্রকে তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই নিয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। রাজ্যে নির্বাচন এসে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে নতুন সরকার গঠিত হলে তাদের বিবেচনার জন্য বিষয়টি রেখে দেওয়া হোক। মনে করা হচ্ছে, রাজ্যপাল এ ক্ষেত্রেও তাঁকে সহায়তা করতে পারবেন।

সব বিষয়ে এমনই তালমিলের কথা মাথায় রেখে এগোতে চাইছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। বাকিটা বলবে ভবিষ্যৎ।

রাতেও কাজ, ছুটির দিনেও কাজ, ফরমান প্রথম দিনেই

রঞ্জন সেনগুপ্ত • কলকাতা

প্রথম দিন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, তিনি প্রতিদিনই রাত পর্যন্ত কাজ করবেন। শুধু তা-ই নয়, কাজ করবেন ছুটির দিনেও।

শুধু তিনি নয়, তাঁর সব মন্ত্রীই যে শনিবার মহাকরণে কাজ করবেন, শুক্রবার তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর এই ঘোষণায় ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে মহাকরণে। তাঁর পূর্বসূরির স্লোগান ছিল 'ডু ইট নাউ' বা এখনই করুন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই সেটা কাজে করতে শুরু করে দিলেন। মুখ্যসচিব এবং সব দফতরের সচিবদের সকাল ৯টায় হাজিরার নির্দেশ দিলেন তিনি। সেই নির্দেশ পর্যায়ক্রমে পৌঁছে গেল মহাকরণের নিচু তলা পর্যন্ত। প্রথম দিনটায় নতুন মুখ্যমন্ত্রী যখন মহাকরণ ছাড়লেন, তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ১২টা।

শুক্রবার গোটা দিনটাই অবশ্য ছিল মহাকরণের নড়েচড়ে বসার দিন। শপথগ্রহণের আগেই, বৃহস্পতিবার রাতে ইংরেজিতে এবং এ দিন সকালে বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে সোনালি হরফে 'মমতা ব্যানার্জি' লেখা ফলক বসে গিয়েছিল। আর তার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের সব কর্মী প্রতীক্ষা করছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। শেষ পর্যন্ত তা এল বিকেল ৫টার পরে। তবে সোজা পথে নয়, ঘুরপথে। কারণ, মহাকরণের সংরক্ষিত এলাকায় তখন গিজগিজ করছে মানুষ।

অন্য মন্ত্রীরা শপথ নিয়ে যে-'কনফারেন্স রুম' বা সম্মেলন কক্ষে বসে ছিলেন, মমতাকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানেই। উপচে পড়া জনস্রোত দেখে বিরক্তি গোপন করেননি মমতা। কনফারেন্স রুম এবং মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের মাঝখানে আরও পাঁচটি দরজা। মমতা কনফারেন্স রুমের ভিতরের দরজা দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে পৌঁছন। বিকেল তখন ৫টা। সেখানে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম, মুখ্যমন্ত্রীর সচিব সুবেশ দাস প্রমুখ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।

তার পরেই জানা যায়, বিপুল জনস্রোত ঠেলে মহাকরণে পৌঁছনোর সময় কোনও ভাবে মমতার পায়ে আঘাত লেগেছে। মহাকরণের মেডিক্যাল টিমের লোকজন তাঁর ঘরে গিয়ে প্রাথমিক পরিচর্যা করেন। ওই আঘাত অবশ্য নতুন মুখ্যমন্ত্রীকে এতটুকুও দমাতে পারেনি। ব্যাহত হয়নি তাঁর দৌড়োদৌড়ি। মহাকরণে নিজের ঘরে ঢুকে যাওয়ার পরেও বার দুয়েক আচমকাই বেরিয়ে আসেন মমতা। তাঁকে বেরোতে দেখে কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়েন আলোকচিত্রীরা। হইহই করে ওঠেন সংরক্ষিত এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র মানুষ। ফের ঘরে ঢুকে যান মুখ্যমন্ত্রী।

তৃতীয় বার ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর পেরিয়ে মমতা সোজা পৌঁছে যান ব্যালকনিতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত মানুষকে দেখে হাত নাড়েন তিনি। কয়েক মিনিট পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাঁ দিকে, যেখানে আগে আইনমন্ত্রীর ঘর ছিল, সে-দিকে হাঁটতে শুরু করেন। ব্যালকনির শেষ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ফিরে আসেন। তখনও কয়েকশো মানুষ তাঁকে ধাওয়া করেন। হুড়োহুড়িতে এক মহিলা পড়ে যান। তাঁরই সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান এক পুরুষও। ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পিঠে মৃদু চাপড় মেরে তিরস্কার করেন, "পিছনে মেয়ে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছো না!"

বিকেলেই মমতা মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় (সিএমও) ঘুরে দেখেন। সেখানে একটি কনফারেন্স রুম রয়েছে দেখে তাঁর মন্তব্য, "বাহ! এটাকে তো অ্যান্টিচেম্বার করা যাবে!" পূর্তসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনকে ডেকে বলেন, "ঘরে আলো খুব কম মনে হচ্ছে।" এ বিষয়ে বাকি আলোচনা তিনি শনিবার করবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর ঘরে মনীষীদের বড় ছবি টাঙানোরও নির্দেশ দিয়েছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী।

জ্যোতি বসু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দেওয়ার পরে বসুর চেয়ারে বসেননি বুদ্ধবাবু। জ্যোতিবাবুর চেয়ারটি মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের লাগোয়া একটি ছোট ঘরে রাখা আছে। এ দিন মমতাও বুদ্ধবাবুর চেয়ারে বসেননি। বুদ্ধবাবুর চেয়ারের ঠাঁই হয়েছে জ্যোতিবাবুর চেয়ারের পাশেই। মমতার জন্য ঘরে এসেছে তিনটি চেয়ার। একটি রিভলভিং এবং দু'টি কাঠের চেয়ার। যখন যে-চেয়ারে বসতে ইচ্ছা হবে, তখন সেটিতে বসবেন তিনি।

তবে এ দিন আর নিজের ঘরে বেশি ক্ষণ বসতে পারলেন কই! প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকের সময় হয়ে গিয়েছিল। তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী।

কী সেই কাজ?

মালদহের ভাবুক গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝাড়পুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মিনতি কিস্কু কোলের বাচ্চাকে নিয়ে দুপুর থেকেই অপেক্ষা করছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের পাশে। মিনতিকে এক সময় ডেকে নেন তিনি। ধর্ষণের ফলে মিনতি বছর দুয়েক আগে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তখন তাঁর পাশে কেউ দাঁড়াননি বলে অভিযোগ এসেছিল মমতার কাছে। ওই যুবতীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। মিনতি ঘরে ঢুকতেই তাঁর বাচ্চার গাল টিপে দেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। ত্রাণ তহবিল থেকে মিনতির জন্য ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করার পাশাপাশি সাংবাদিক বৈঠকে মমতা জানান, ওই যুবতীকে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পে চাকরি দেওয়া হবে।

'পরিবর্তন'-এর মানবিক মুখ।

বহু গুরুত্বপূর্ণ দফতর থাকল মমতারই হাতে

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

পুলিশ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, কৃষি, সংখ্যালঘু উন্নয়ন— ছ-ছ'টি গুরুত্বপূর্ণ দফতর আপাতত হাতে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে রাখলেন তথ্য ও সংস্কৃতি, পার্বত্য বিষয়ক দফতর, কর্মিবর্গ দফতরও।

জোট-শরিক কংগ্রেসের জন্য ছাড়া হল সেচ এবং মৎস্য দফতর। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়া হচ্ছেন সেচমন্ত্রী। সঙ্গে পাচ্ছেন ক্ষুদ্রশিল্প দফতরও। তাঁর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরে প্রতিমন্ত্রী করে দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে। কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা আবু হেনা হচ্ছেন মৎস্যমন্ত্রী।

এ বারের বিধানভা ভোটে 'জায়ান্ট কিলার' হিসেবে উঠে এসেছেন তৃণমূলের একগুচ্ছ বিধায়ক। তাঁদের মধ্যে মণীশ গুপ্ত পাচ্ছেন উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরের দায়িত্ব। যাদবপুরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব মণীশবাবু। প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবকে দমদমে হারিয়ে-আসা ব্রাত্য বসু হচ্ছেন উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে যিনি হারিয়েছিলেন, সেই রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে মন্ত্রী করা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের।

প্রত্যাশিত ভাবেই অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন ফিকি-র প্রাক্তন মহাসচিব অমিত মিত্র। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁকে তথ্যপ্রযুক্তি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, শিল্প পুনর্গঠন দফতরের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিনেই মন্ত্রিসভা ছাড়াও বিধানসভার দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। স্পিকার হিসেবে বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি স্পিকার হিসেবে সোনালি গুহের নাম প্রস্তাব করা হবে ঠিক হয়েছে।

মন্ত্রীদের মধ্যে অমিতবাবু এবং পার্থবাবুই শুধু তাঁদের দফতরের দায়িত্বের কথা গোড়ায় জেনে গিয়েছিলেন। বিকেলে মহাকরণে পৌঁছে একমাত্র অমিতবাবুই নিজের ঘরে বসতে পারেন। বাকিদের দফতরের ঘোষণা হয় রাত সাড়ে বারোটায়! মহাকরণে মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যকে নিয়ে মমতা দীর্ঘ বৈঠকের পরে মধ্যরাতে পার্থবাবু আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্ত্রীদের দফতর ঘোষণা করেন।

প্রথম দিনের কাজ শেষে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণ ছেড়েছেন রাত সাড়ে বারোটার পরে। আজ, শনিবার মহাকরণ ছুটি থাকা সত্ত্বেও নতুন মন্ত্রীদের আসতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিজেও আসবেন। স্বভাবতই, দফতরে আসতে হবে অফিসার এবং কর্মীদেরও। একেবারে প্রথম দিন থেকেই মহাকরণের রুটিন বদলে দিয়েছেন মমতা!

মমতা-সহ এ দিন তৃণমূলের ৩১ জন পূর্ণমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। কংগ্রেসের পূর্ণমন্ত্রী দু'জন। পাশাপাশি, তৃণমূলের চার জন প্রতিমন্ত্রীও শপথ নিয়েছেন। এর পরে কংগ্রেসের পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কথা। সব মিলিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪২। যা বামফ্রন্ট জমানার মন্ত্রিসভার কলেবরের চেয়ে খুব সামান্যই ছোট! এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মমতা অবশ্য বলেছেন, "বিধায়কদের ১৫%-কে মন্ত্রী করার নিয়ম আছে। নিয়ম মেনেই তো হয়েছে।" বিধায়ক সংখ্যার অনুপাতে মন্ত্রিসভার আয়তন কী হবে, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ভোটের আগে তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রিসভা হবে ছোট।

বাম জমানায় মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে জেলা কমিটিগুলির তালিকা মেনে চলার রীতি ছিল। মমতার ক্ষেত্রেও জেলা থেকে মন্ত্রী নেওয়ার 'চাপ' ছিল। কিন্তু তাঁর দলে মমতাই যে হেতু শেষ কথা, তাই চাইলে তৃণমূল নেত্রীই মন্ত্রিত্বে 'জেলা-কোটা'র ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন বলে রাজনৈতিক শিবিরের মত।

বাম জমানার মতোই বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ধরে দফতর বণ্টন করেছেন মমতা। বাম জমানার কিছু দফতর ভেঙে আলাদাও করে নিয়েছেন। সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা উন্নয়ন দফতর নিজের হাতে রেখেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে আব্দুল করিম চৌধুরীকে জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী করা হয়েছে। জাভেদ খান হচ্ছেন অসামরিক প্রতিরক্ষা ও দমকলমন্ত্রী। প্রাক্তন বিচারপতি নুরে আলম চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর। প্রাক্তন আইপিএস হায়দর আজিজ সফি হচ্ছেন সমবায়মন্ত্রী। অনগ্রসর কল্যাণ দফতর পাচ্ছেন প্রাক্তন সিবিআই-কর্তা উপেন বিশ্বাস। জঙ্গলমহলে এ বার তৃণমূলের 'অপ্রত্যাশিত' ভাল ফলের পরে ঝাড়গ্রামের বিধায়ক সুকুমার হাঁসদাকে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরের পূর্ণমন্ত্রী করেছেন মমতা।

তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায় হচ্ছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুব্রতবাবু কংগ্রেস জমানায় মন্ত্রী ছিলেন। প্রায় ৪০ বছর পরে তিনি আবার মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। সুব্রত বক্সি দায়িত্ব নিচ্ছেন পূর্ত এবং পরিবহণ দফতরের। মদন মিত্রকে দেওয়া হয়েছে ক্রীড়া দফতরের প্রতিমন্ত্রীর স্বাধীন দায়িত্ব। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী। ফিরহাদ (ববি) হাকিম হচ্ছেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী।

বিভিন্ন জেলা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটের 'সাফল্যে'র প্রতিদান দফতর বণ্টনের মাধ্যমেই দিতে চেয়েছেন মমতা। যেমন, যে সিঙ্গুরের আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক পুনরুত্থানের অন্যতম ভিত্তি, সেখানকার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে স্কুল শিক্ষামন্ত্রী করেছেন মমতা। রবীন্দ্রনাথবাবু পেশায় শিক্ষক। পূর্ব মেদিনীপুরের সব ক'টি আসন জিতেছে তৃণমূল। ওই জেলা থেকে চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার পরিবেশ দফতর ও সৌমেন মহাপাত্রকে জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর দেওয়া হচ্ছে। গৌতম দেবকে দেওয়া হচ্ছে নতুন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব। বালুরঘাটের শঙ্কর চক্রবর্তী পাচ্ছেন কারা প্রশাসন ও অপ্রচলিত শক্তি দফতরের দায়িত্ব। মালদহের সাবিত্রী মিত্র নারী ও শিশুসমাজ দফতরের মন্ত্রী। বীরভূম থেকে চন্দ্রনাথ সিংহ পাচ্ছেন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব। রাঢ়বঙ্গে তৃণমূলের ফল এ বার ভাল হয়েছে। ওই অঞ্চল থেকে শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায় আবাসন এবং শান্তিরাম মাহাতো স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রী হচ্ছেন।

কংগ্রেসের মন্ত্রীদের পূর্ণ তালিকা কয়েক দিনেই

সঞ্জয় সিংহ • কলকাতা

গামী সপ্তাহের গোড়াতেই জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে দলের আরও পাঁচ মন্ত্রীর নামের তালিকা তুলে দিতে চায় কংগ্রেস।

মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারে কংগ্রেসের পাঁচ প্রতিমন্ত্রীর নামের তালিকা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সোমবার বা মঙ্গলবারের মধ্যে সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর কাছে পাঠানো হবে বলে পশ্চিমবঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, "আমরা আশা করি, আগামী সপ্তাহেই আমাদের মন্ত্রীরা শপথ নিয়ে কাজ শুরু করে দেবেন।"

মমতা-সহ তৃণমূলের ৩১ জনের সঙ্গেই কংগ্রেসের দুই পূর্ণমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ও আবু হেনা এ দিন শপথ নিয়েছেন। পূর্ণমন্ত্রীদের পাশাপাশি শপথ নিয়েছেন তৃণমূলের চার প্রতিমন্ত্রীও। কংগ্রেসের 'সম্ভাব্য' মন্ত্রীদের মধ্যে দেবপ্রসাদ রায়, অসিত মাল, আবু নাসের খান চৌধুরী, অজয় দে-র মতো কয়েক জনকে রাজভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছে। কিন্তু আদৌ তাঁরা মন্ত্রী হবেন কি না, তা তাঁদের কাছে এ দিনও স্পষ্ট নয়! দেবপ্রসাদবাবু তো বলেই দেন, "আমি যে মন্ত্রী হব, তা তো এখনও জানিই না! তবে মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে আমার কাছে বড় ব্যাপার হল, ৩৪ বছর ধরে বাংলায় সিপিএমের যে অপশাসন চলেছে, তার অবসান হয়েছে। আর আমি সেই ঐতিহাসিক কীর্তির এক জন সৈনিক হয়েছি, এটাই বড় ব্যাপার!"

পালাবদলের উল্লাস। — সুমন বল্লভ

স্বভাবতই এমন পরিস্থিতিতে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন কংগ্রেসের বিধায়কেরা। দলের পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রীর নাম ঠিক করা নিয়ে কী সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাবে শাকিল এ দিন বলেন, "তালিকা করার ক্ষেত্রে এবং তা অনুমোদনের জন্য যে সময় দরকার, তা পাওয়া যায়নি বলেই বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।" রাজভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরে তিনি জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই তালিকা সম্পূর্ণ করার কথা ছিল। কিন্তু বারাণসীতে দলের একটি বৈঠক থেকে কংগ্রেস সভানেত্রীর দিল্লি ফিরতে দেরি হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাননি শাকিল, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা মনোনয়নের ব্যাপারে পর্যবেক্ষক এ কে অ্যান্টনি। বৃহস্পতিবার রাতে অ্যান্টনি ও শাকিল কালীঘাটে গিয়ে মমতার হাতে 'সিল'-করা যে খামটি দেন, তাতে পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে মানসবাবু ও আবু হেনার নাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

বিষয়টির সবিস্তার ব্যাখ্যাা করে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র ওমপ্রকাশ মিশ্র জানান, মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারে কংগ্রেস যোগ দেবে কি না, তা নিয়ে প্রথমে শাকিল মতামত নেন নবনির্বাচিত দলীয় বিধায়কদের। অধিকাংশ বিধায়কই মন্ত্রিসভায় যোগদানের পক্ষে মত দেন। এর পরেই আসে পরিষদীয় দলের নেতা মনোনয়নের প্রশ্ন। ইতিমধ্যে মমতা জানিয়ে দেন, তিনি কংগ্রেসকে দুই পূর্ণমন্ত্রী ও পাঁচ প্রতিমন্ত্রীর পদ দিতে চান। আবু হেনাকে পরিষদীয় দলের নেতা মনোনীত করেন সনিয়া। ফলে, তিনি পরিষদীয় দলের নেতা হিসাবে যেমন এক জন পূর্ণমন্ত্রী হন, তেমনই পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি মানসবাবুর নামও চূড়ান্ত করে কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ড। ওমপ্রকাশবাবু বলেন, "এ বার পাঁচ প্রতিমন্ত্রী কে হবেন, তা স্থির করতে গিয়ে কতগুলি মাপকাঠি নেওয়া হয়। প্রথমত, যাঁরা তিন-চার বারের বিধায়ক, সেটা দেখা দরকার। অন্য দিকে, তৃণমূল নেত্রী যেমন তাঁর দলের মন্ত্রী করার সময়ে সংখ্যালঘু, মহিলা, যুব এবং অঞ্চলভিত্তিতে করেছেন, আমাদেরও সেটা করতে সময় লাগছে। এই ব্যাপারে অলোচনা চলছে।"

প্রদেশ কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁচ প্রতিমন্ত্রীর তালিকা নিয়ে কিছুটা 'জট' পাকিয়েছে। কারণ, মানসবাবু ও হেনা পূর্ণমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পরে দলের যে পাঁচ জনকে প্রাথমিক ভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে চার জনই 'প্রবীণ ও অভিজ্ঞ'। তাঁরা শেষ পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী হতে রাজি হবেন কি না, এটা নিয়েও কিছুটা 'সংশয়' রয়েছে। মালদহে বরকত গনি খান চৌধুরীর ভাই, সুজাপুরের বিধায়ক আবু নাসের খান চৌধুরী ও মোথাবাড়ির বিধায়ক সাবিনা ইয়াসমিনের মধ্যে কাকে প্রতিমন্ত্রীর তালিকায় রাখা হবে, তা নিয়েও দলের মধ্যে কিছুটা টানাপোড়েন রয়েছে। শাকিল অবশ্য বলেন, "কোনও জটিল পরিস্থিতি বা টানাপোড়েন নেই। তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে বলেই একটু দেরি হচ্ছে। তবে সমস্যা হবে না। দু'এক দিনের মধ্যেই আমাদের পাঁচ প্রতিমন্ত্রী শপথ নেবেন।"

বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত

অর্থমন্ত্রী অমিতই, শিল্প দফতর পার্থর

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

প্রত্যাশিত ভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ধরে মন্ত্রিসভার দফতর বণ্টন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে প্রাথমিক ভাবে মমতা তাঁর মন্ত্রিসভায় দু'টি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করেছেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফিকি-র প্রাক্তন মহাসচিব অমিত মিত্রকে। বস্তুত, মহাকরণে পৌঁছে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে অমিতবাবুই সব চেয়ে আগে নিজের ঘরে গিয়ে বসেন। জোট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার সঙ্গেই তাঁকে দেওয়া হয়েছে পরিষদীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব।

বাকি মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টনের জন্য শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মহাকরণে বৈঠক চলছে। যা সাম্প্রতিক কালের মধ্যে একেবারেই নজিরবিহীন! তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্ভাব্য পরিবহণমন্ত্রী হতে পারেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্ত। যাদবপুরে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়ে আসার পরে মণীশবাবুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্বই দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। আমলা হিসাবে কর্মজীবনে মণীশবাবু পরিবহণ সচিবও ছিলেন। পরিবহণ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে পারেন কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র। সিপিএম জমানায় যেমন সিটুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতাদের পরিবহণ দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হত, মদনবাবুরও তেমন ট্যাক্সি ইউনিয়ন পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।

অতীতে কংগ্রেস জমানার মন্ত্রী এবং অধুনা তৃণমূল বিধায়ক সুব্রত মুখোপাধ্যায় সম্ভবত পূর্তমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন। সম্ভাব্য পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। গত বছরই তাঁকে কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে জিতে-আসা চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে পারেন। ওই জেলারই সৌমেন মহাপাত্র পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর পেতে পারেন। আইন ও বিচারমন্ত্রী হতে পারেন প্রাক্তন বিচারপতি নুরে আলম চৌধুরী। উত্তরবঙ্গ থেকে আব্দুল করিম চৌধুরী হতে পারেন সংখ্যালঘু উন্নয়নমন্ত্রী। শিক্ষা সংক্রান্ত দু'টি দফতর ভাগ করা হতে পারে রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও ব্রাত্য বসুর মধ্যে। এই দু'জনই এ বার 'জায়ান্ট কিলার' হিসাবে উঠে এসেছেন। রবিরঞ্জনবাবু হারিয়েছেন বিদায়ী শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে, ব্রাত্য হারিয়েছেন বিদায়ী আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবকে।

কংগ্রেসের দুই পূর্ণমন্ত্রীর মধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়া পেতে পারেন সেচ দফতরের দায়িত্ব। তবে সবই নির্ভর করছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সিদ্ধান্তের উপরে। মমতা-সহ ৩৩ জন পূর্ণমন্ত্রী এ দিন শপথ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩১ জন তৃণমূলের, দু'জন কংগ্রেসের। শপথ নিয়েছেন চার জন প্রতিমন্ত্রী। এর পরে কংগ্রেসের আরও পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কথা। সব মিলিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪২। যা বামফ্রন্ট জমানার মন্ত্রিসভার কলেবরের চেয়ে বিশেষ ছোট নয়! এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন বলেন, "মোট বিধায়ক সংখ্যার ১৫% মন্ত্রী হওয়ার তো নিয়ম আছে। নিয়ম মেনেই হয়েছে।" মমতা বোঝাতে চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথা। তবে আইনের গণ্ডি না-ছাড়ালেও জেলার 'চাপ' অগ্রাহ্য করা যে মমতার পক্ষেও সম্ভব হয়নি, এই মন্ত্রিসভার তালিকা থেকেই তা স্পষ্ট। তবে সিপিএমের ক্ষেত্রে যেমন জেলা কমিটির তালিকাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপার থাকত, তৃণমূলে মমতাই শেষ কথা। তাই পারলে তিনিই এই 'জেলা-কোটা'র ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন বলে রাজনৈতিক শিবিরের অভিমত।

গভীর রাতে দফতর, সারা দিন ঘরহীন অনেক মন্ত্রী

অশোক সেনগুপ্ত ও স্বপন সরকার • কলকাতা

পথ নিয়ে ওঁরা একে একে পৌঁছে গেলেন মহাকরণে। মুখ্যমন্ত্রী আসার আগেই পৌঁছলেন কেউ। কেউ এলেন তাঁর সঙ্গে। মহাকরণে তো পৌঁছলেন, কিন্তু ওঁদের ঘর কোথায়? দফতরই বণ্টন হয়নি যে! দোতলায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘর সংলগ্ন কনফারেন্স রুমে বসলেন তাঁরা। কেউ কেউ করিডরে গিয়ে আড্ডা দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী কাজে নেমে পড়লেও, বেশির ভাগ মন্ত্রীর এ দিন কোনও 'কাজ' ছিল না।

ব্যতিক্রম অমিত মিত্র। মহাকরণে ঢুকেই তিনি চলে যান অর্থমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। শিল্প ও বাণিজ্য দফতর পেলেও তিনি ছিলেন মমতার সঙ্গেই। কখনও সময় কাটিয়েছেন ক্যাবিনেট রুমে বা কনফারেন্স রুমে, অন্যদের সঙ্গে। পার্থবাবুর সঙ্গীরা রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত উৎসুক নয়নে তাকিয়ে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের দিকে। সেখানে তখনও তিনি বৈঠক করে চলেছেন।

শপথ নিয়ে এ দিন বিকেল সওয়া তিনটেয় সবার আগে মহাকরণে পৌঁছন সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার। মমতা পৌঁছন সুদর্শনবাবুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। মহাকরণে পৌঁছে কিছুক্ষণ সভাকক্ষে বসেন সুদর্শনবাবু। ইতিমধ্যে চলে আসেন অমিত মিত্র এবং মণীশ গুপ্ত। মহাকরণের চার্চ সংলগ্ন গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকেন তাঁরা। এর কিছুক্ষণ পরে প্রবল জনজোয়ারে ভেসে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা হেঁটে এলেও অমিতবাবু, মণীশবাবুরা গাড়িতেই আসেন।

নতুন অর্থমন্ত্রী অমিতবাবু মহাকরণে ঢোকেন পৌনে পাঁচটা নাগাদ। এসেই মোবাইল ফোনে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তার পরেই সোজা চলে যান অর্থমন্ত্রীর ঘরে। সেখানে অর্থসচিব সি এম বাচওয়াতের সঙ্গে কিছু ক্ষণ আলোচনা করেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "আমি অর্থনীতিবিদ হিসেবে সচিবের কাছে কিছু বিষয় বোঝার চেষ্টা করেছি। মন্ত্রী হিসেবে এখন কিছু বলার নেই।" সন্ধ্যায় হায়দর আজিজ সফি ক্যাবিনেট রুম থেকে বেরিয়ে বলেন, "এখনও জানি না কোন দফতর পাব।" রাত ৯টার পর রচপাল সিংহ সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে তিন তলায় পরিবহণ সচিবের ঘরে বিশ্রামে যান। তিনিও বলেন, "এখনও জানি না কোন দফতর পাব। তবে নেত্রীর নির্দেশে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে মহাকরণে চলে আসতে হবে। "

এরই মধ্যে রাত ৯টা ২০ মিনিটে ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেন, "আমি পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব পাচ্ছি। কলকাতা পুরসভায় আমি এই দফতরে কাজ করি। নেত্রী আমার কাজে হয়তো দক্ষতার পরিচয় পেয়েছেন। তাই দায়িত্ব দিয়েছেন।" কিন্তু সরকারি ভাবে তখনও সেই ঘোষণা হয়নি।

রাত ১০টায় হতাশ হয়ে মহাকরণ ছেড়ে চলে গেলেন মালদহের মানিকচক থেকে জিতে আসা সাবিত্রী মিত্র। কোন দফতর পেলেন? হেসে জবাব দিলেন সাবিত্রী, "ভালবাসা!"

মহাকরণ সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের নির্দেশে মন্ত্রীদের ঘর সাজানো হয়েছে বৃহস্পতিবার রাতেই। এ দিন পূর্ত দফতরের কর্তারা সেগুলিতে 'ফিনিশিং টাচ' দিয়েছেন। প্রতি ঘরের বাইরে নেমপ্লেট খোলা। নতুন নামের অপেক্ষায় সেই সব দেওয়াল। মন্ত্রীদের নাম ঘোষণায় দেরি হওয়ায় পূর্ত দফতরের কর্মীদেরও অপেক্ষা করতে হয়েছে গভীর রাত পর্যন্ত। আজ, শনিবার সাত সকালে ফের হাজিরা দিতে হবে ওই কর্মীদের। কারণ, মহাকরণের পূর্ত দফতরেও এই শনিবারের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

প্রথম দিনেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা সকলকে

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সর্িতে বসেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রূপায়ণের কাজ শুরু করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

যে সব বিষয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আক্রমণাত্মক ছিলেন, সেই সব বিষয়কেই যে তাঁর মন্ত্রিসভা অগ্রাধিকার দেবে, শুক্রবারই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, সংখ্যালঘু, আদিবাসী-সহ গরিব মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিতে চেয়েছেন প্রথম দিনেই। যে বিপুল ভোটব্যাঙ্ক তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্বে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর দলকে দ্বিধাহীন সমর্থন জুগিয়েছে— এ দিন তাদের সবাইকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন মমতা।

মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই গরিব মানুষের জন্য ১০০ দিনের কাজ এবং বিপিএল তালিকা তৈরির জন্য যেমন একটি আলাদা বিভাগ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী, তেমনই প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারকে রাজ্যে এনে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে প্যাকেজ তৈরির কথাও বলেছেন। সেই সঙ্গে জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য পৃথক প্যাকেজ তৈরি, পাহাড়ের সমস্যার দ্রুত সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতার মন্ত্রিসভা। উত্তরবঙ্গের জন্য ছোট হলেও পৃথক সচিবালয় গড়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

এই সব কাজ দ্রুত করার জন্য মন্ত্রীদের শনিবারের ছুটি আপাতত বাতিল করে দিয়েছেন মমতা। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, আগে মাসে এক বার মন্ত্রিসভার বৈঠক হত। কিন্তু তাঁরা দ্রুত কাজ চান। তাই এ বার থেকে ১৫ দিন অন্তর বৈঠক হবে। আগামী বুধবার ফের মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।

এ দিন মহাকরণে ঢুকেই অর্থনীতিবিদ অমিত মিত্রকে অর্থ দফতরের পরিস্থিতি জানতে নির্দেশ দেন মমতা। সেই মতো মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে অর্থ দফতরের সচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অমিতবাবু।

মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নির্দিষ্ট কোনও আলোচ্যসূচি ছিল না। বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, "মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতেই আমরা মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।" তার পর নেওয়া হয় একাধিক সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রী জানান, মন্ত্রিসভা ঠিক করেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্যাকেজ তৈরি করা হবে। এ ব্যাপারে মতামত দেওয়ার জন্য সাচার কমিটির চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র সাচারকে অনুরোধ করবে রাজ্য সরকার। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে। প্রতিহিংসার কারণে যাঁদের দীর্ঘদিন কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে, তাঁদের মুক্তির জন্য প্রাক্তন বিচারক, মানবাধিকার কর্মী ও প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে ১০ সদস্যের 'রিভিউ কমিটি' হবে। কমিটি প্রতিটি মামলা ধরে পর্যালোচনা করবে।

এ দিনের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মমতা বলেন, "কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে বিপর্যয় মোকাবিলার বিশেষ দল আছে। জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনার সময়ে দলটি কাজ করেছিল। আমি শুনেছি, ওই দলকে কাজ করাতে মাসে একটি টাকা দিতে হয়। এ ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর নেব।"

এর পরেই তিনি জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। পাশাপাশি বন্যার জল ধরে রেখে অন্য কাজে লাগানোর ব্যাপারেও ওই কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হবে। এ ছাড়াও বন্যা ব্যাপারে আগাম সতর্কতা এবং তা প্রতিরোধের স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।

একশো দিনের কাজ ও দরিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের বিপিএল কার্ড পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা দেখার জন্য একটি পৃথক বিভাগ গড়ার কথা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, "গরিবদের কেন বিপিএল কার্ড বা কাজ পেতে অসুবিধা হচ্ছে, তা দেখার জন্যই ওই বিভাগ গড়া হবে।"

পাহাড় ও জঙ্গলমহলের সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা। এ দিন মন্ত্রিসভা বৈঠকেও তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পরে তিনি বলেন, "দার্জিলিংয়ের সমস্যা নিয়ে শীঘ্রই বসব। জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্যাকেজ তৈরি করব বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওখানে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা গড়া হবে। সাঁওতালি ভাষা পড়ানোর জন্য পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হবে।" পাহাড় ও জঙ্গলমহলের সমস্যা তিন মাসের মধ্যেই মেটাতে চান মমতা। তিনি বলেন, "এর মধ্যে যদি কেউ শান্তির জন্য কথা বলতে চান, তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তাঁদের স্বাগত জানাব।" তবে জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনী সরানোর ব্যাপারে এখনই মুখ খুলতে রাজি হননি মমতা। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "এখন নির্বাচনের জন্য ওখানে বাহিনী রয়েছে। পরে বিষয়টি 'ক্রস-চেক' করে দেখতে হবে।"

মন্ত্রিসভায় আলোচনা না-হলেও ভোটের পরে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে ভাবে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মমতা। তিনি বলেন, "আরও অনেক (অস্ত্র) এ দিক, ও দিকে আছে। সব উদ্ধার করতে হবে।"

আগামী সাত দিন তাঁর কাজকর্ম ভাল করে বুঝতে চান নতুন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন তিনি বলেন, "ভিড়ের জন্য কিছুই দেখতে পারলাম না। এর জন্য সাত দিন সময় দিতে হবে। তার পর মানুষ যাতে তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা জানাতে পারেন, তারও ব্যবস্থা করা হবে।"

দাঁত ভাঙা বাংলায় শপথবাক্য, পরিবর্তন নয় কেন

দেবাশিস ভট্টাচার্য • কলকাতা

বিষয়টি খুবই সাদামাঠা। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে পক্ষপাতহীন ভাবে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অঙ্গিকার এবং মন্ত্রীর বিবেচনা অনুযায়ী তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য শপথ গ্রহণ।

কিন্তু রাষ্ট্রভাষা ছাড়া 'অধিক রোষ' প্রকাশ পায় না বলে 'ছিনাথ বহুরূপী'কে যেমন পিসেমশাইয়ের হিন্দি বকুনি শুনতে হয়েছিল, অনেকটা তেমনই মন্ত্রিত্বের 'মান' রাখতে হয়তো ভারী ভারী কিছু সংস্কৃত শব্দ সহযোগে সাধু বাংলায় শপথবাক্য পাঠ অবশ্য কর্তব্য। তাই বছরের পর বছর ধরে দু'টি জটিল বাংলা বয়ানে দায়িত্ব এবং মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়ার ধারা চলে আসছে।

আর তার এক একটি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে মন্ত্রীদের। আগেও হয়েছে, শুক্রবারও হল। কেউ কেউ ধাক্কা খেলেন 'শুদ্ধান্তঃকরণে' বলার সময়, কারও জিভ জড়িয়ে গেল 'সার্বভৌমত্ব'-এ। অনেকে সম্ভবত বুঝতেই পারলেন না, "মন্ত্রীরূপে যে কোনও বিষয়, যাহা আমার বিবেচনার জন্য আনীত হইবে বা আমি অবগত হইব, তাহা ওই মন্ত্রীরূপে, আমার কর্তব্যসমূহের যথোচিত নির্বাহের জন্য আবশ্যক না হইলে, আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের নিকট সঞ্চারিত বা ব্যক্ত করিব না", জাতীয় বাক্যবন্ধের অর্থ কী এবং তার সঠিক পাঠ ও যতি কী ভাবে হওয়া উচিত। ফলে তাঁদের পড়ায় বিষয়টি প্রায় 'হাঁসজারু' চেহারা পেল।

তবু এটাই করতে হবে। না পারলেও পড়তে হবে। কারণ সরকারি কেতাবে এই বাংলা বয়ানই 'বেঁধে' দেওয়া আছে। মহাকরণ থেকে রাজভবন সবারই বক্তব্য: বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সংবিধানের স্বীকৃত সরকারি অনুবাদ রয়েছে। মন্ত্রীদের শপথের বয়ান তারই অঙ্গ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট দফতর এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত। সেখান থেকে মূল ইংরেজির এই রকম বাংলা অনুবাদ এসেছে। সেটিই বরাবর পড়া হয়। বদলের কোনও 'অধিকার' নেই। অর্থাৎ মূল গলদটা অনুবাদে।


গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হয়। সরকার বদলে যায়। তা হলে শপথের বয়ানে কেন থাকবে এই 'তাসের দেশ' মার্কা নিয়ম? মুখের কথা থেকে সাহিত্যের ভাষা সব কিছু যখন পরিবর্তনশীল, শপথের বয়ানকে সহজবোধ্য, সাবলীল করা কি সেখানে খুব কঠিন?

"সেটা তো আমারও প্রশ্ন", বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শুক্রবার রাজভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন তিনি। দেখেছেন, শুনেছেন এবং বুঝেছেন, বিড়ম্বনা কোথায়। তাঁর কথায়, "এই রকম খটমটে বাংলায় শপথ বাক্য পড়তে হলে আমি মন্ত্রী হতেই পারতাম না! সব কিছুর যদি পরিবর্তন হয়, এটাই বা হবে না কেন? চলিত ভাষা নয় কেন?"

একমত শঙ্খ ঘোষও। তাঁর মতে, "এই বয়ানকে আরও সহজ করা যায়। আরও স্বচ্ছন্দ বাংলায় অনুবাদ করলে তো ভালই হয়। এখনকার বাংলা বয়ানের গায়ে লেগে রয়েছে ইংরেজি থেকে অনুবাদের আড়ষ্টতা।"

কেমন হওয়া উচিত সেই অনুবাদ? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের প্রাক্তন শিক্ষক পরেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, "যে ভাষায় মানুষ কথা বলে, শপথ গ্রহণের ভাষাকে তার কাছাকাছি আনা উচিত। এখন যে বাংলায় শপথ গ্রহণ করা হয়, তা শুনলে মনে হয় কোনও অবাঙালির করা অনুবাদ। গাম্ভীর্য চলিত রীতিতেও আনা যায়।" ভাষা গবেষক অশোক মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেন, "শপথ গ্রহণের ভাষা আইনি ভাষার মতোই হবে, যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, দুটো অর্থ হওয়ার সুযোগ না থাকে। তবে সমস্ত দিক বিবেচনা করেও ইংরেজি থেকে অনুবাদের আড়ষ্টতা এড়িয়ে শপথবাক্যের ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি আনা যায়। সে ব্যাপারে এত দিন কোনও চেষ্টা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।"

এ বার কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে চান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি সুনীলবাবু বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। তিনি বলেন, "অকাদেমি থেকে আমরা সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানাতে পারি। সে ক্ষেত্রে আমরা বলব, সরকার যদি আমাদের ভার দেয়, তবে সাহিত্য অকাদেমির পক্ষ থেকে বাংলা-সহ অন্য আঞ্চলিক ভাষাগুলিতেও এই সব বয়ানের স্বচ্ছন্দ, সাবলীল অনুবাদের কাজ হাতে নিতে পারি।"

'তাসের দেশ'-এ নিয়মের রাজত্ব বদলায় কি না, এ বার সেটাই দেখার।

পিএস-দের মেয়াদ বৃদ্ধি এক সপ্তাহ

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

রাজ্যের প্রাক্তন ৪৪ জন মন্ত্রীর পি এস বা একান্ত সচিবদের সরিয়ে দেওয়ার সরকারি নির্দেশে শুক্রবার সামান্য পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই সব একান্ত সচিবকে এক সপ্তাহের মধ্যে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশে এই পরিবর্তনের ফলে তাঁদের মেয়াদ বাড়ল এক সপ্তাহ। তবে তার আগেই যদি কোনও নতুন মন্ত্রী নিজের পছন্দমাফিক নয়া একান্ত সচিব নিয়োগ করেন, তা হলে তখনই বর্তমান একান্ত সচিবকে ওই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হবে।

পুরনো দফতরের কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে একান্ত সচিবদের যোগাযোগ করতে হবে স্বরাষ্ট্র কর্মিবর্গ দফতরে। পরিবর্তিত ব্যবস্থায় তাঁদের কোথায় কোন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেটা ঠিক হবে পরে। সদ্য-প্রাক্তন মন্ত্রীদের একান্ত সচিবদের নিজেদের দায়িত্ব শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল গত বুধবার। আর সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিটি জারি হয়েছে শুক্রবার, নতুন মন্ত্রিসভার শপথের দিনেই। মন্ত্রীদের একান্ত সচিবদের মধ্যে বেশির ভাগই ডব্লিউবিসিএস অফিসার। একই ব্যাপারে এক দিনের ব্যবধানে দু'টি বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ায় তাঁদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

মহাকরণ সূত্রের খবর, একান্ত সচিবদের কাজের মেয়াদ মন্ত্রীদের মেয়াদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই মন্ত্রীদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের একান্ত সচিবদের প্রস্থানই স্বাভাবিক। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়ে মন্ত্রীরা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একান্ত সচিবেরা এমনিতেই বিদায় নেন। তার জন্য আলাদা নির্দেশ জারি করার প্রয়োজন হয় না।


অর্থমন্ত্রী অসুস্থ
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

গভীর রাতে মন্ত্রিসভার বৈঠক সেরে মহাকরণ থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই পেটে যন্ত্রণা শুরু হয় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ভর্তি করানো হয় আইটিইউ-তে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাতেই সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে তাঁর। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, গত ক'দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম, খাওয়ার অনিয়মের ফলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অমিতবাবু।

ছোট্ট গাড়িটার চারপাশে ভেঙে পড়ল গোটা পাড়া

ঋজু বসু

কাল থেকেই প্রস্তুত ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রিট। কড়কড়ে পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে অফিসঘরে বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন বাড়ির ছেলেরা। বৌরাও সেজেগুজে তৈরি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘরের মেয়ের শপথগ্রহণ দেখতে তাঁর ভাই ও ভ্রাতৃবধূরা দল বেঁধে রাজভবনের দিকে রওনা দিলেন।

যাওয়া হল না শুধু পরিবারের সব থেকে বর্ষীয়ান কর্ত্রীর। মমতার মা গায়ত্রীদেবী এখন অসুস্থতার জন্য গৃহবন্দি। শুক্রবারও তিনি বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি। দিনভর তাঁর সঙ্গে বাড়িতে থেকে মমতার বোন রিনাদেবীও টিভির পর্দায় চোখ রাখলেন।

যাওয়া হয়নি আরও এক জনের। 'শুভ' শুক্রবারের দুপুর ১টার 'মাহেন্দ্রক্ষণে' বাড়ির সামনে বিপুল ভিড়টা সাময়িক পাতলা হলেও মমতার চিলতে অফিসঘরের চেয়ারে অটল থাকলেন শীর্ণকায় সেই প্রবীণ। আড়াই দশক ধরে মমতার অফিস-ম্যানেজার মানিক মজুমদার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন ইনিংস শুরুর দিনেও 'দিদি'র সংসারের চাবি সেই বিশ্বস্ত হাত দু'টোই আগলে রাখল।

বাড়ি থেকে রাজভবনের পথে বেরোচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাড়ির বৌরা— চন্দনা, লতা, কাজরী, রিনা ও কল্পনা দল বেঁধে একটি গাড়িতে ওঠেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে মমতার এক ভ্রাতৃবধূ অফিসে মানিকবাবুর কাছে এসে ছোট বোনের মতোই আবদার করলেন, "মানিকদা, আমরা সবাই কোন গাড়িতে যাব, তুই একটু দেখ্‌ না!"

রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণের দিনটাতেও 'মানিকদা'র ৩৬৫ দিনের রুটিনে কোনও হেরফের হয়নি। তাড়া-তাড়া শুভেচ্ছা-চিঠি, কার্ড, স্মারক উপহার, ফুল-মিষ্টি গুছিয়ে রাখতে রাখতে মমতার দীর্ঘ দিনের সৈনিক নিজের মুখেই শোনালেন এই বিশেষ দিনটায় দিদির প্রতি তাঁর 'অবাধ্যতা'র কাহিনি। মানিকবাবুর কথায়, "দিদি আমাকেও রাজভবনের কার্ড দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবাই গেলে ঘর (পড়ুন, অফিস) সামলাবে কে! তাই দিদিকে বুঝিয়ে অফিসে থাকার সিদ্ধান্তই নিলাম।"

১৯৮৪-তে যাদবপুরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে 'দিদি'র জয়ের কিছু পরেই হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রিটের অফিসের ভার মানিকবাবুর কাঁধে। অফিস-সর্বস্ব রোজনামচার প্রসঙ্গে অকৃতদার প্রৌঢ়ের সরল স্বীকারোক্তি, "৮৪ সালে এক বার দিল্লি গিয়েছিলাম। তার পরে কোথাও গিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। আরে, কলকাতার রাস্তাই আমি ভুলে গিয়েছি!"

ভোটগণনার সকাল থেকে মমতার বাড়ির সামনের বাঁশের ব্যারিকেডটা এ দিন আরও দীর্ঘ। মমতার জন্য নিয়ে আসা পুজোর ফুল বা 'দিদি'র ক্ষীরের পুতুল-মিষ্টিকে ভিতরে প্রবেশাধিকার দিতে নিরাপত্তারক্ষীদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। মমতা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে দলের নেতাদের কাউকে দেখামাত্র শাঁখ-উলুতে ফেটে পড়েছে গোটা পাড়া। আর অফিসঘরে সাদা রঙের ল্যাণ্ডলাইন ফোনটাও অবিশ্রান্ত বেজে চলেছে।

সেই সময়ে মমতার বাড়ির অফিসে রোজকার মতো ব্যস্ত মানিক মজুমদার। শুক্রবার।

সেই কোন সকাল থেকে ব্যারিকেডের ও পারে সুশৃঙ্খল ভাবে অপেক্ষায় বিপুল জনতা। সবার একটাই প্রশ্ন— রাজভবনে রওনা হওয়ার আগে দিদি এক বার আমাদের দিকে আসবেন তো! বেলা সাড়ে ১২টায় গাড়িতে ওঠার আগে মমতা সত্যিই নাটকীয় ভাবে ঘুরে সেই জনতার সঙ্গে হাত মেলাতে গেলেন। অপেক্ষমান কালো স্যান্ট্রো গাড়িটা ঘিরে তখন হাত ধরাধরি করে কর্ডন করেছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁদের কার্যত হিমশিম খাইয়েই মমতা ছুটে গেলেন ব্যারিকেডের দিকে। খাতায়-কলমে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে 'দিদি'র শেষ ঘোষণা: "সপ্তাহে এক বার আমি সরাসরি আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।"

ব্যক্তিগত সচিব গৌতম সান্যালকে পিছনে বসতে বলে গাড়ির সামনের আসনে বসেন মমতা। নিজের পাড়ার গলিতে নেত্রীর পথচলা শুরুর পরেও ঢাকের বাদ্যি উৎসবের আবহে চারপাশ মুড়ে রাখল। আর দিদির গাড়ি পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ভিড় কিছুটা সরলে ঘরের টিভিটায় চোখ রাখার ফুরসত পেলেন তাঁর অফিসের প্রহরীরা।

ছবি: সুদীপ আচার্য

first page

বুলেটপ্রুফ নয়, টোল খাওয়া পুরনো গাড়িই পছন্দ

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে দলেরই দেওয়া সাধারণ গাড়িতে চড়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও যে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চড়বেন না, তা আরও স্পষ্ট করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

পুরনো গাড়িতেই যে তিনি স্বচ্ছন্দ, শুক্রবার, প্রথম দিনেই মহাকরণে তা স্পষ্ট করে দিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, "আমার একটা ছোট গাড়ি আছে। ওটা আবার আমার নামেও না। দলের গাড়ি। আমি ওটাই চড়ব। বাইরে গেলে আমার মতো করে গাড়ির ব্যবস্থা করে নিতে পারব।" বস্তুত, এ দিন শপথ নেওয়ার জন্য মমতা যে-গাড়িতে রাজভবনে পৌঁছন, সেটা তাঁর দলেরই দেওয়া সেই টোল খাওয়া কালচে রঙের গাড়ি।

মমতার কালীঘাটের বাড়িতে দাঁড়িয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়ি। এই গাড়িটিই
ব্যবহার করতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।— সুদীপ আচার্য

কেন্দ্রীয় সরকারের সুপারিশ মেনে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মমতাকে সুরক্ষার সর্বোচ্চ স্তর— 'জেড প্লাস' নিরাপত্তা দিয়েছিল বিগত সরকার। ওই ব্যবস্থায় বুলেটপ্রুফ গাড়ি ছাড়াও একাধিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার (পার্সোনাল সিকিওরিটি অফিসার) দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি কোনও দিনই রাজ্য পুলিশের দেওয়া বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চড়েননি। তা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বহু চিঠি চালাচালি হলেও ওই গাড়ি কখনও প্রত্যাহার করেনি রাজ্য সরকার। কলকাতা কিংবা জেলা, মমতা যখন যেখানে গিয়েছেন, তাঁর কনভয়ে রাজ্যের দেওয়া বুলেটপ্রুফ গাড়ি ফাঁকাই গিয়েছে। এবং এখনও যে সেই বন্দোবস্তের কোনও বদল হবে না, রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তার কথায় তা পরিষ্কার। ওই আধিকারিক এ দিন বলেন, "মমতাদেবী 'জেড প্লাস' নিরাপত্তা পান। সেই বন্দোবস্তে বুলেটপ্রুফ গাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। তাই মুখ্যমন্ত্রী ওই গাড়ি ব্যবহার করুন বা না-করুন, তাঁর কনভয়ে সেটা থাকবেই।"

এ দিনও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ গিতে যাওয়ার পথে মমতার কনভয়ে আগাগোড়া ছিল পুলিশের দেওয়া বুলেটপ্রুফ গাড়ি। এবং মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির পিছনে যথারীতি ফাঁকাই গিয়েছে সেটি। দিনভর মহাকরণের গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাতে সেটি খালিই ফেরে কালীঘাটে। বুলেটপ্রুফ গাড়ি নিতে অস্বীকার করেছেন। তবে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আর কিছু বলতে রাজি হননি নতুন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, "ওটা 'ইন্টারনাল' ব্যাপার, 'টেকনিক্যাল'ও। পুলিশ নিজের কাজ করবে।" সেই সঙ্গে মমতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, "নিরাপত্তার নামে আমি কোনও ভাবেই জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হব না।"

মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেও থাকছে এই গাড়ি। সেই গাড়িতেই
রাজভবনে ঢোকার মুখে। শুক্রবার। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

শুধু বুলেটপ্রুফ গাড়ি নয়, কনভয়ে 'পাইলট কার' রাখতেও এ দিন বারণ করেছিলেন মমতা। এক পুলিশকর্তা বলেন, "নতুন মুখ্যমন্ত্রী আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, বাড়ি থেকে রাজভবনের পথে যেন কোনও 'পাইলট কার' না-থাকে। সেই নির্দেশই মেনেছে পুলিশ। তাঁর নিরাপত্তায় থাকা পুলিশের সব গাড়ি ছিল কনভয়ের পিছনে।" এর ফলে রাজভবনের পথে একাধিক বার ভিড়ে আটকে গিয়েছে মমতার গাড়ি। মহাকরণ থেকে ফেরার পথেও পাইলট কার ছিল না তাঁর কনভয়ে।

তবে মমতার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ) থাকা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে এত দিন রাজ্যের যে চাপান-উতোর চলছিল, এ বার তার অবসান হল বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, ''এখন তো রাজ্য পুলিশ মমতাদেবীরই। ওরাই তাঁর নিরাপত্তা দেবে।" কিন্তু মমতা গত দু'বছর যে আরপিএফের নিরাপত্তা-বলয়ে ছিলেন, এখনও তিনি সেই রক্ষীদের পাহারাতেই থাকবেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী শুক্রবার বলেন, "আরপিএফের যাঁরা এত দিন রেলমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ছিলেন, তাঁদের রাজ্যে ডেপুটেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরাই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন।" এ দিনও শপথ অনুষ্ঠান থেকে মহাকরণ, বুকে 'পরিচয়পত্র' লাগিয়ে আরপিএফের জওয়ানেরাই ঘিরে ছিলেন মমতাকে।

জনসুনামির ঢেউয়ে সওয়ার, পায়ে হেঁটে মহাকরণে 'দিদি'

শমীক ঘোষ

শ মিনিটের পথ পেরোতে সময় লাগল পাক্কা সাতচল্লিশ মিনিট!

রাজভবনে শপথ অনুষ্ঠানের পরে মমতা যে হেঁটে মহাকরণ যেতে পারেন, তার একটা আঁচ পেয়েছিলেন পুলিশ কর্তারা। ভিড় সামলাতে গভর্নমেন্ট প্লেস-ইস্ট, কাউন্সিল হাউস ষ্ট্রিট জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল ব্যারিকেডও। কিন্তু শুক্রবার বেলা আড়াইটের পর থেকে রাজভবনের উত্তর আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের রাস্তা, কিরণশঙ্কর রায় রোড এবং হেয়ার ষ্ট্রিটে জমতে থাকা ভিড় পুলিশ কর্তাদের উদ্বেগ এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু তখনও তাঁদের মনের কোণে আশা, শেষমেষ হয়তো গাড়িতেই যাবেন মমতা! হাজার হোক, এখন আর তিনি বিরোধী নেত্রী তো নন! মুখ্যমন্ত্রী! পুলিশ কর্তাদের নিশ্চয়ই এমন 'বিপদে' ফেলবেন না তিনি!

কিন্তু মমতা সে পাত্রী নন! জননেত্রী 'দিদি' জননেত্রী হয়েই মহাকরণে ঢুকতে চান! যে মহাকরণ থেকে ১৮ বছর আগে তাঁকে হেঁচড়ে বার করে দেয় পুলিশ! এ দিন সেই মহাকরণে আক্ষরিক অর্থেই তাঁর প্রবেশ-পথ তৈরি করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেল পুলিশ!

এমনিতে এ দিন বেলা সাড়ে বারোটার পর হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রিটের বাড়ি থেকে গাড়িতে রাজভবন পৌঁছন মমতা। প্রথমে গোপালনগর, পরে ভবানী ভবন পেরিয়ে ভবানীপুরের মোড়ে তাঁর গাড়ি আটকে শুভেচ্ছা জানান উৎসাহী মানুষ। লালবাজারের এক কর্তা স্বীকার করেন, "তখনই বোঝা গিয়েছিল জনতার ঢল রাস্তায় নেমে পড়বে। কিন্তু তার চেহারা যে এমন হবে, তা কে ভেবেছিল!"

জনতার ঢল। শুক্রবার বিকেলে মহাকরণের সামনের রাস্তায়। — সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়

ট্রাফিক পুলিশ কর্তাদের হিসেব ছিল রাজভবন থেকে মহাকরণ (ভায়া কাউন্সিল হাউস ষ্ট্রিট) এক কিলোমিটারও নয়। কম দূরত্বের মাত্র চারটে ক্রসিং। কিরণশঙ্কর রায় রোড, হেয়ার ষ্ট্রিট, জিপিও, তার পরেই মহাকরণ। গাড়িতে বড় জোর দশ মিনিট লাগবে। গাড়িতে বসে জনতার দিকে হাত নাড়াতে নাড়াতেও যদি মুখ্যমন্ত্রী যান, তা হলেও দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু সব হিসেবই গোলমাল হয়ে যায় তাঁদের। এমনটাই তো ঘটেছিল ৩৪ বছর আগেও।

১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শপথ গ্রহণের পরে গাড়িতেই মহাকরণ পৌঁছেছিলেন জ্যোতিবাবু! সেই খবর দিতে গিয়ে ২২ জুনের আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল:... এর পর রাজভবনের পশ্চিম দরজা খুলে যায়। পুলিশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বিবাদী বাগ এলাকার নারী পুরুষ কর্মীরা গাড়ি যাওয়ার জন্য সামান্য রাস্তা করে দিলেন। কিন্তু পথটুকু পেরোতেও তাদের প্রায় ৫০ মিনিট সময় লাগে...।

এ দিন বিকেল চারটে নাগাদ লালবাজারের পুলিশ কর্তারা নিশ্চিত হয়ে যান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা হেঁটেই মহাকরণ যাচ্ছেন এবং বিকেল চারটের খানিক পরে তিনি রাজভবন থেকে বেরোচ্ছেন দক্ষিণ-পশ্চিম গেট দিয়ে (শপথ নিতে তিনি ঢুকেওছিলেন ওই গেট দিয়েই)। আর, তখনই লালবাজারের কর্তাদের ঘুম ছুটে যায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে।

জননেত্রীর নিরাপত্তা আর মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা, তফাত তো থাকবেই!

শুক্রবার, বিকেল ৪টে ৬ মিনিট। বেলা একটা থেকে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকশো লোককে ঠেলে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদব্রজে মহাকরণ যাত্রা সুনিশ্চিত করার একটা চেষ্টা করল পুলিশ। কিন্তু তার আগেই রাজভবনের দিকের ফুটপাথে তৈরি করা ব্যারিকেড মুখ থুবড়ে পড়েছে গভর্নমেন্ট প্লেস-ইস্টে।

পুলিশ-পরিবৃত হয়ে মমতা রাজভবন থেকে বেরিয়ে আসতেই নিমেষে বিশৃঙ্খল হয়ে গেল জনতার ভিড়। তাঁর আগে-পিছনে তখন হাজার হাজার মানুষ। সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মহাকরণমুখী। কাউন্সিল হাউস ষ্ট্রিটে জনজোয়ার পৌঁছনোর আগেই গভর্নমেন্ট প্লেস-ইস্ট জুড়ে ছেঁড়া চটি-জুতো, ভাঙা চশমা, পেন, টেলিফোন ডায়েরির ছড়াছড়ি। মহাকরণের দিকে মানুষের ঢল যত এগিয়েছে ততই সেই চটি, চশমার সংখ্যা বাড়তে থেকেছে।

তমলুক থেকে 'দিদি'কে দেখতে এসেছিলেন কালাচাঁদ সাঁপুই। পায়ে ধুতি জড়িয়ে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট প্লেস-ইস্টে। জনজোয়ারে হারিয়েছেন এক পাটি চটি। এক পুলিশ অফিসার তাঁকে টেনে তুলে মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, "অনেক বার করে আপনাদের বললাম, ফুটপাথে ব্যারিকেডের ভিতরে থাকুন। কিছুতেই শুনলেন না।" বছর পঞ্চান্নর কালাচাঁদের জবাব, "এত দিন তো ধমকেছেন। আর ধমকাবেন না।"

তবে সত্যিই এ দিন 'ধমকে'র মেজাজে ছিল না পুলিশ। বিপুল ভিড়, অগুন্তি ভিআইপি, যান নিয়ন্ত্রণ— সব মিলিয়ে এ দিনটা নির্বিঘ্নে উতরে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা বড় কম ছিল না। কিন্তু এ দিন পুলিশের ভূমিকা যেন অনেকটা অষ্টমী পুজোর রাতের মতো। কাতারে কাতারে মানুষ। তবু মারমুখী হওয়া নেই, মেজাজ হারানো নেই। যতটা সম্ভব বুঝিয়েসুঝিয়ে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। রাস্তায় এক সময় নিরাপত্তার কর্ডন ভেঙে দিয়েছে মানুষের ঢল। তবু এই 'ঐতিহাসিক পদব্রজ' ঘিরে জনতার আবেগকে যথাসম্ভব মর্যাদা দিয়ে কার্যত বেসামাল একটা পরিস্থিতিই কোনও মতে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে পুলিশ।

কিরণশঙ্কর রায় রোড আর কাউন্সিল হাউস ষ্ট্রিটের সংযোগস্থলটা পেরোতেই পারছিলেন না মমতা। তাঁকে দেখতে এবং তাঁকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করতে করতে একেবারে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েন মানুষ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সদ্য শপথ নেওয়া অনেক মন্ত্রীও তখন ভিড়ের চাপে ছিটকে পড়েছেন মমতার বৃত্ত থেকে। ওয়েস্টবেঙ্গল ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সামনে দিয়ে জনজোয়ার যাওয়ার সময় কলকাতার পুলিশ কমিশনার আর কে পচনন্দাকেও প্রায় দিশেহারা দেখাচ্ছিল। তিনিও মমতার পিছন পিছন হাঁটছিলেন। রাস্তার দু'ধারে সরকারি বা বেসরকারি অফিসের ছাদেও কাতারে কাতারে লোক। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে উঠে মোবাইলের ক্যামেরায় মমতার পদযাত্রার ছবি তুলছেন বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীরা। মহাকরণের সামনে ভিড়ের চোটে ভিতরে ঢুকতে পারছিলেন না মমতা। তারই মধ্যে মহাকরণের কর্মীরা বেশ কয়েক দফা পুষ্পবৃষ্টি করেন নতুন মুখ্যমন্ত্রীর উপরে। ১৮ বছর পর এ ভাবেই মহাকরণে 'প্রত্যাবর্তন' হল মমতার।



মহাকরণ জনতার, ঘুরপথে নিজের ঘরে মুখ্যমন্ত্রী

সুব্রত বসু ও শ্যামল মুখোপাধ্যায়

মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনের সংরক্ষিত এলাকা নয়। এ যেন এক হট্টমেলা!

কে নেই সেখানে? ফুলের তোড়া হাতে সরকারি নানা সংগঠনের কর্তা, সবুজ আবির মাখা তৃণমূল কর্মী, বগলের ফাইলকে 'গেটপাশ' বানিয়ে ঢুকে পড়া মহাকরণের 'আমজনতা'! আর তাঁদেরই চাপের ঠেলায় বিপর্যস্ত বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিয়ে গড়া নিরাপত্তা বলয়। সবাই এক বার নতুন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে চান।

মহাকরণের বারান্দায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — সুদীপ আচার্য

মানুষের চাপে মহাকরণের ব্যারিকেড এক সময় ভেঙেই গেল! মহাকরণের ভিতরে-বাইরে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও রাজভবন ছাড়েননি। মহাকরণের দোতলা, তিন তলার ভিআইপি করিডরে থিকথিক করছে কালো মাথা। চিৎকার চেঁচামেচি। কে বলবে পরিচয়পত্র ছাড়া প্রবেশ নিষেধ মহাকরণে! সকালের দিকে 'অবাধ প্রবেশ' রুখতে কিন্তু তৎপর ছিল পুলিশ। সাধারণ কর্মীদের তো বটেই, এমনকী সাংবাদিকদেরও তল্লাশির পরেই মহাকরণের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দা একাধিক বার পুলিশি ব্যবস্থার তদারকি করে গিয়েছেন। কিন্তু বেলা বাড়তেই পুলিশ বুঝে যায়, এই জনস্রোতকে আটকানোর ক্ষমতা তাদের নেই। বেলা ১২টা থেকেই মহাকরণ চলে গেল জনতার কব্জায়! আর তাঁদের জন্য মমতা সোজা পথে ঢুকতেই পারলেন না তাঁর ঘরে!

এর আগে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখতে প্রেস কর্নারে টিভি দেখার জন্য ভিড় জমান অনেকে। কেউ আবার টিভির খোঁজে বিভিন্ন মন্ত্রীর ফাঁকা ঘরে ঢোকেন। প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর ঘরেও টিভি চালিয়ে বসে পড়েন কেউ কেউ। একে একে সবাই ভিড় জমাতে থাকেন করিডরগুলিতে। কখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে আসবেন, তাই নিয়েই সারা দুপুর চলেছে জল্পনা-কল্পনা। সাংবাদিক দেখলেই প্রশ্ন, "দাদা কিছু খবর পেলেন? কখন মুখ্যমন্ত্রী আসবেন?" এর পর জানা যায় নতুন মুখ্যমন্ত্রীর মহাকরণে আসতে চারটে বেজে যাবে। এই খবর জানার পর সংরক্ষিত এলাকার ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়।

মহাকরণের ছাদেও দর্শকের ভিড়। শুক্রবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

দুপুর তিনটে নাগাদ ফের সংরক্ষিত এলাকায় ভিড় জমতে শুরু করে। পুলিশ নাইলনের দড়ি এবং হাত দিয়ে ব্যারিকেড করে ভিড় সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই কাজে আসেনি। মহাকরণের ভিতরে এবং বাইরে জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে শুধু কালো মাথা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। রাজভবন থেকে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণের দিকে যত এগোন, ততই বাড়তে থাকে ভিড়। এক সময় ভিড়ের চাপে নিরাপত্তা বলয় ভেঙে পড়ে! ভিড়ের চাপে অসুস্থও হয়ে পড়েন অনেকে।

জনস্রোতে ভেসে মমতা যখন মহাকরণের ৬ নম্বর গেটের সামনে এলেন, তখন মহাকরণের বাইরের রাস্তায় এবং ভিতরেও তিল ধারণের জায়গা নেই। ওই গেটের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্তারা বলেন, "ম্যাডাম, এই গেট নয়, আপনাকে সেন্ট্রাল গেট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।" সেন্ট্রাল গেটের ভিআইপি লিফট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের কোনওক্রমে ভিতরে আনা গেলেও মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে প্রচণ্ড ভিড় দেখে তাঁকে সরাসরি সে ঘরে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেননি নিরাপত্তা কর্মীরা। ভিআইপি লিফটের পাশেই কনফারেন্স রুমে নিয়ে যাওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যদের। ওই কনফারেন্স রুমের ভিতর দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয় মমতা বন্দ্যোপ্যাধ্যায়কে।

বিধানচন্দ্র রায়ের মূর্তিতে মাল্যদান। ছবি: অশোক মজুমদার।

১৮ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে যে ঘরের সামনে থেকে এক দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পুলিশ দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার, সেই ঘরেই আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঢুকবেন! তাঁকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবেন পুলিশই! এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত এক বার চোখের দেখা দেখার জন্য সবার মধ্যেই প্রবল আগ্রহ ছিল, তেমনই সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করে রাখার জন্য চিত্র-সাংবাদিকদের মধ্যেও হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তাঁকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এবং স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম। কিন্তু ভিড়ের চাপে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁরা স্বাগত জানাতেও পারেননি।

বাইরে তখন জনসমুদ্র। বাইরের ভিড় মহাকরণের দেওয়ালে এসে আছড়ে পড়ছে। অবস্থা সামাল দিতে পুলিশ বাধ্য হয়ে মহাকরণের ভিআইপি গেট বন্ধ করে দেয়। ভিতর থেকেও শোনা যাচ্ছিল বাইরের জনজোয়ারের গর্জন। ফিরহাদ হাকিম জানলা দিয়ে বাইরের জনতাকে শান্ত হয়ে চলে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে কেউ কান দিলে তো! এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পোডিয়ামে এসে বিধানচন্দ্র রায়ের মূর্তিতে মালা দেন। তখন তিনি বারান্দায় এসে বাইরে অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। এবং ইঙ্গিতে তাঁদের চলে যেতে অনুরোধ করেন। তুমুল গর্জনে নতুন মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেও সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় অবশ্য অটুটই ছিল মহাকরণের সামনে। সামাল দিতে লালবাজার থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী এলেও ভিড় বিশেষ নড়েনি।

যাত্রা শুরু...

ফ্রেমে বন্দি মমতা। ছবি: অশোক মজুমদার।

রাত যত বেড়েছে, ভিড়ও ততই হাল্কা হয়েছে। ততক্ষণে নতুন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কানে গিয়েছে আমজনতার। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, অনেক রাত পর্যন্ত মহাকরণে কাজ করবেন তিনি।

স্ক্রিনে 'দিদি'কে দেখতে রোদ মাথায় নিয়েই ভিড়

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিরহাট থেকে পড়িমরি করে ধর্মতলায় পৌঁছেও শেষরক্ষা হল কই!

ভিডিও ক্যামেরার ব্যবসায়ী পিন্টু খান মেট্রো চ্যানেলের 'জায়ান্ট স্ক্রিন'-এর সামনে পৌঁছনোর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ-পর্ব শেষ। টিফিনটাইমে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের অফিস থেকে হেঁটে ধর্মতলায় পৌঁছেছিলেন রাজ্য পরিবহণ দফতরের কর্মী অশোক ভট্টাচার্য ও বুলা পুশিলাল। একটুর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ 'মিস্‌' হয়ে গেল তাঁদেরও। বাকিদের শপথপাঠে মনোযোগ দিলেও শহরের বিভিন্ন এলাকায় জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে জনতা বিগত বাম সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের খোঁজ নিতেও সারাক্ষণ উৎসাহে ফুটেছে। 'রাজভবনে বুদ্ধবাবু-বিমানবাবুকে দেখাল নাকি?' জানতে চেয়ে কৌতুহলী ফিসফাস টিভি বা বড়পর্দার আশপাশে ঘুরপাক খেয়েছে।

রাজভবনে ঢোকা দূর অস্ত্‌। তবু ঘরের ভিতরের আরামে টিভিতে চোখ রাখার পরোয়া করেননি অনেকে। জ্যৈষ্ঠের কলকাতার কড়া রোদ ও প্যাচপেচে অস্বস্তি তুড়ি মেরে উড়িয়ে ঐতিহাসিক মুহূর্তের আঁচ গায়ে মাখতে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটে বেড়িয়েছেন অনেকেই।

মেট্রো চ্যানেলের জায়ান্ট স্ক্রিনে মমতার শপথ দেখতে জনজোয়ার।— অর্কপ্রভ ঘোষ

চন্দননগরের প্রবীর মজুমদার, বাপ্পা রায়, পিন্টু সোম, সন্দীপ সোমদের জনা আটেকের দলটা সাতসকালেই হাজির হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রিটের বিখ্যাততম বাড়িটির সামনের মাঠে। 'দিদি' রাজভবনে রওনা হলে ওঁরাও গাড়িতে পিছু-পিছু যত দূর সম্ভব এগিয়েছেন। শেষটায় শহিদ মিনার ময়দানে জায়ান্ট স্ক্রিনে চোখ রেখে প্রবীরবাবু বললেন, "যা-ই বলুন, এত লোকের মাঝে সিনেমার মতো বড় পর্দায় এ দৃশ্য দেখার মজাই আলাদা।"

একই সুর সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আবুল কালাম ও তাঁর স্ত্রী মাসুদা আখতারিরও। আদতে তাঁরা মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বাসিন্দা। অনেকের সঙ্গে শপথগ্রহণ দেখতে রাজারহাটের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে উজিয়ে ভরদুপুরে সোজা শহিদ মিনারের মাঠে। কারা যেন ওই দম্পতির কপালে সবুজ আবিরের টিপ পরিয়ে দিয়েছে। চড়া রোদে সেই টিপ ঘামে গলে পড়ার জোগাড়!

বিহারের আরা জেলার বিষ্ণুপুরা গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধ রামশরণ আহিরের আবেগেরই বা কী ব্যাখ্যা হয়? অনুষ্ঠান শেষে জাতীয় সঙ্গীতের সুর থামার পরেও ধর্মতলায় আপনমনে কংগ্রেস ও মমতার ছবি দেওয়া তৃণমূলের পতাকা দু'হাতে বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে চলেছেন। বললেন, "আমি বঙ্গালের ভোটার নই। কিন্তু মমতার টানে এসেছি। মমতা গরিবদের ভাল করবে, তাই।"

ক্যামেরায় 'পরিবর্তন' ধরে রাখছেন কোয়েল মল্লিক।— অশোক মজুমদার

হাওড়া স্টেশন, ধর্মতলার মোড়, শহিদ মিনারের বড় পর্দাগুলির সামনে দাঁড়ানো ভিড়টার আবেগে রাজভবনের সরকারি অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য খান খান। তবে কলকাতা পুরসভার পাশে পর্দা টাঙিয়ে সরাসরি সম্প্রচার যান্ত্রিক গোলযোগে ভেস্তে যায়। পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল সমর্থকেরা বড় টিভির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে। বেহালার ১৪ নম্বর বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে বিকেল চারটেতেও নিউজ চ্যানেলের 'রিপিট টেলিকাস্ট' দেখতে ভিড়।

যাদবপুরের 'জায়ান্ট কিলার' মণীশ গুপ্তের শপথের সময়েই টিভি ক্যামেরা প্রথম বার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ধরল। দেখে ধর্মতলায় ভিড়ের উল্লাস আর ধরে না! হাততালি কেড়ে নেওয়ায় মমতার পরেই থাকবেন ব্রাত্য বসু ও রচপাল সিংহ। আর এক প্রাক্তন আইপিএস হায়দর আজিজ সফির শপথের সময়ে কতর্ব্যরত পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের এক ইনস্পেক্টরের কণ্ঠে মুগ্ধতা: "উনি লালবাজারে ডিসি-ডিডি (গোয়েন্দাপ্রধান) থাকার সময়ে ওখানেই সাব-ইনস্পেক্টর ছিলাম। কাছ থেকে ওঁকে দেখেছি।"

তবে শপথ চলাকালীন উৎসুক জনতাও এক বার কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকেছিল। উত্তরবঙ্গ থেকে জিতে আসা বিধায়ক গৌতম দেবের নাম ঘোষণার পরে সামান্য স্তব্ধতা। তার পরই অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল ভিড়টা।

শপথগ্রহণ থেকে 'ছুটি' নিয়ে গরহাজির গৌতম

সন্দীপন চক্রবর্তী

মতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথের দিন যিনি 'বন্‌ধ' ডাকার হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি 'ছুটি' নিলেন!

তৃণমূল নেত্রীর বাড়িয়ে-দেওয়া সৌজন্যের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রাজভবনে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। কিন্তু অনুপস্থিত থেকে 'নজর' কাড়লেন প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব! মন্ত্রিত্বে থাকাকালীন এবং তার পরেও সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন করে চলার তত্ত্বের যিনি প্রবল প্রবক্তা। গৌতমবাবুর কথায়, রাজ্যপাটে মমতার অভিষেকের দিনটায় তিনি 'ছুটি' নিয়েছিলেন!

ভোটের ফল যা-ই হোক, তার পরে মমতাকে তিনি একটা ফোন করবেন বলে আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন গৌতমবাবু। গত ১৩ মে, ফলপ্রকাশের দিন এবং শুক্রবার নতুন সরকারের শপথের দিন এক বারের জায়গায় অন্তত চার বার তিনি মমতাকে ফোন করেছিলেন বলে জানিয়ে গৌতমবাবুর দাবি, প্রথম তিন বার ফোন কেউ ধরেনি। শেষ বার ব্যক্তিগত সচিব জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে 'ব্যস্ত' আছেন। তার আগে মমতার মন্ত্রিসভা এবং পরিষদীয় দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফোনে ধরার চেষ্টা চালিয়েছেন।

কিন্তু পার্থবাবুর ফোন সব সময়ই 'ব্যস্ত'। এই ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে রাজভবনে আর যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি গৌতমবাবুর। তাঁর কথায়, "আমাদের দলের তরফে শীর্ষ নেতৃত্বের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। বুদ্ধদা, বিমানদা গিয়ে সেই বার্তা দিয়েছেন। আমি আজকের দিনটায় ছুটি নিলাম! সরকারি দফতর চালিয়েছি ২০ বছর। বিরোধীদের সঙ্গে সব সময় ভাল সম্পর্ক ছিল। বিধানসভার নথিতেই তার প্রমাণ আছে। চার বারের পর পাঁচ বার ফোন করাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না?"


গৌতমবাবুর রাজভবনে অনুপস্থিতি আরও চোখে পড়েছে এই কারণেই যে, বৃহস্পতিবার রাতেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আলোচনায় তিনিই মত দিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু-বিমানবাবুদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পক্ষে। মমতা যে ভাবে সৌজন্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার পরে তাঁদের দলের রাজ্য নেতৃত্বের ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজ্যবাসীর কাছে 'সৌজন্য-বার্তা' পৌঁছে দেওয়া উচিত ছিল বলে গৌতমবাবু যুক্তি দিয়েছিলেন। আবাসনমন্ত্রী থাকাকালীনও রাজারহাট-নিউটাউনের একাধিক অনুষ্ঠানে বিরোধীদের আমন্ত্রণ জানাতে কখনও 'ভুল' হয়নি তাঁর। সেই গৌতমবাবুরই এ দিনের অনুষ্ঠানে না-থাকা স্বভাবতই 'বিস্ময়' সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক শিবিরে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতমবাবু অবশ্য বলছেন, বুদ্ধবাবু-বিমানবাবু যেখানে উপস্থিত, সেখানে তাঁর না-যাওয়াটা 'গৌণ'।

বুদ্ধবাবুর মন্ত্রিসভা এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিরুপম সেন বৃহস্পতিবারই জানিয়েছিলেন, তিনি রাজভবনে থাকতে পারবেন না। ব্যক্তিগত ভাবে যেতে না-পারলেও ফুল এবং শুভেচ্ছা-বার্তা পাঠিয়ে তিনি নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তা হলে কি 'আহত' গৌতমবাবু সচেতন ভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন এ দিনের অনুষ্ঠান থেকে? মমতার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক হয়ে যাওয়ার পরে রাতে গৌতমবাবু বলেন, "নাঃ! আহত নই! ওঁরা এখন ব্যস্ত। উচ্ছ্বাস দু'দিন বাদে কমে আসবে। তখন প্রশান্তি আসবে! তখন আশা করি, ওঁরা সরকার এবং বিরোধীদের ভূমিকা ভেবে দেখবেন। বিরোধী আসনে থেকে ওঁরা কী করেছিলেন, ফিরে দেখবেন! আমি ছুটি নিয়ে দলীয় মুখপত্রের জন্য এই সংক্রান্তই একটা লেখা লিখলাম।"

এ বারের বিধানসভা ভোটে সিপিএমের প্রচারের প্রধান 'মুখ' অবশ্য জানাচ্ছেন, সরকার-বিরোধী সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার যুক্তি থেকে তিনি এর পরেও সরে আসছেন না। তাঁর মতে, তৃণমূল এ বার তাঁদের চেয়ে ৩৩ লক্ষ ভোট বেশি পেয়েছে। কিন্তু বামেরাও ১ কোটির বেশি মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। বিরোধীদের মর্যাদা দেওয়া মানে বিপুল সংখ্যক মানুষকেও মর্যাদা দেওয়া। গৌতমবাবুর কথায়, "ওঁদেরও (তৃণমূল নেতৃত্ব) আত্মসমীক্ষা করতে হবে। কোনটা ঠিক করেছেন, কোনটা ভুল করেছেন বিবেচনা করে সত্যে উপনীত হতে হবে। আমরা সরকারে থাকার সময়েই ভুল স্বীকার করেছি। সত্যিই যেখানে যেখানে ভুল হয়েছে, বিরোধী ভূমিকায় গিয়ে সে সব স্বীকার করতে তো আরওই অসুবিধা হবে না।"

তৃণমূল শিবিরের একাংশ অবশ্য মনে করছে, রাজভবন চত্বরে যে ধরনের ভিড় জমা হয়েছিল এ দিন, তাতে গৌতমবাবু সেখানে গেলে তাঁর 'বিদ্রূপে'র মুখে পড়ারও আশঙ্কা ছিল। কারণ, প্রচার-পর্বে তিনি যে ভাবে মমতা এবং তৃণমূলকে ক্রমাগত কটাক্ষ করেছিলেন, তার পরে এ দিনের উৎসব-আবহে তাঁকে পেলে তৃণমূল-সমর্থক জনতা 'ছাড়ত না'! গৌতমবাবু অবশ্য এ সব নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছেন না। তিনি বলছেন, "সরকার থেকে বিরোধী, এই ভূমিকাটাই পাল্টেছে শুধু। দু'পক্ষের সম্পর্ক নিয়ে যা যা বলতাম, সেগুলো পাল্টায়নি।"

মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণে উন্মাদনা রেল-ভবনেও

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথ নিচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তা ঘিরে উন্মাদনা রেল-ভবন জুড়ে। কারণ দু'দিন আগেই তিনি ছিলেন রেলমন্ত্রী। আর মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিতে যাওয়ার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আছেন রেলের পাশেই।

এর আগে কখনও মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিয়ে এত উত্তেজনা দেখেনি রেল-ভবনগুলি। কিন্তু এ বারের মুখ্যমন্ত্রী যে তাদের নিজেদেরই। বৃহস্পতিবার রাতে রেলের নতুন প্রতিমন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণ করেছেন মুকুল রায়। সেখানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মহাকরণের পাশাপাশি রেলের দিকেও খেয়াল থাকবে তাঁর।

শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান দেখার জন্য তাই ছিল কর্মীদের বিশেষ আগ্রহ। যথেষ্ট উৎসাহ ছিল রেল বোর্ডেও। ফেয়ারলি প্লেসের লাল বাড়িটায় শুক্রবার দুপুর পৌনে একটা থেকে বিভিন্ন ঘরে জমতে থাকে কর্মীদের ভিড়। প্রায় দেড়টা পর্যন্ত অনেক ঘরেই টিভির সামনে ছিল জটলা। দফতরের অনেক কম্পিউটারেও সে সময়ে ট্রেন সংক্রান্ত খবরাখবরের বদলে স্ক্রিনে ছিল রাজভবনের অনুষ্ঠানের ছবি।

একই চিত্র দক্ষিণ-পূর্ব রেল ও মেট্রোতেও। দুপুর থেকেই রীতিমতো উৎসবের মেজাজে ছিলেন কর্মীরা। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দফতরের কাছে রাস্তার উপরে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে 'জায়ান্ট স্ক্রিন' বসানো হয়েছিল। অনেক রেলকর্মীই অনুষ্ঠানের সময়ে অফিস ছেড়ে সেখানে গিয়ে ভিড় জমান। মমতার শপথ অনুষ্ঠানের জন্য রেলের তরফে শুক্রবার জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়েছিল শিয়ালদহ এবং হাওড়া স্টেশনেও। কর্মীদের পাশাপাশি যাত্রীদেরও ভিড় ছিল সেখানে। অনেকে আবার সঙ্গে এনেছিলেন পকেট রেডিও। কাজ করতে করতেই বারবার কান লাগিয়ে শুনে নিচ্ছিলেন কখন কোন নেতা-নেত্রী শপথ নিচ্ছেন।

শুধু কর্মীরাই নন, রাজভবনের অনুষ্ঠান দেখতে সকালেই চলে গিয়েছিলেন পূর্ব-রেলের জেনারেল ম্যানেজার স্বয়ং। দক্ষিণ-পূর্ব ও মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজারেরাও গিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। সঙ্গে তাঁদের সচিবেরাও।

শপথ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়েছিল ফেয়ারলি প্লেস। কিন্তু একটু পরেই ফের উন্মাদনা। শোনা গেল, মুখ্যমন্ত্রী হেঁটে যাচ্ছেন মহাকরণে। শোনা মাত্রই কাজ ফেলে নেত্রীকে দেখতে রাস্তায় নামলেন বহু কর্মী।

ছেলে মন্ত্রী, মমতাকে ধন্যবাদ জানালেন বড়মা

নিজস্ব প্রতিবেদন

ড়িতে তখন বেলা ১টা বেজে ঠিক এক মিনিট। রাজভবনে রাজ্যপালের সামনে পশ্চিমবঙ্গের একাদশ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শপথ নেওয়ার পরেই উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা। যাঁরা নিঃশব্দে ভোট গিয়ে এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়েছেন, তাঁদের অনেককেই তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের বিপুল জয়ের পরেও রাস্তায় নেমে প্রকাশ্যে আবেগে ভেসে যেতে দেখা যায়নি। কিন্তু শুক্রবার দুপুরের পর সেই আবেগেই ভাসল উত্তর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের আর একটি কারণ উত্তর ও দক্ষিণ থেকে বেশ কিছু মন্ত্রী পাওয়া।

--নিজস্ব চিত্র।

কক্রবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যখন এক এক করে দুই জেলার মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তি ঘটছিল তখন উত্তর ২৪ পরগনার অনেক জায়গাতেই শোনা যাচ্ছিল শাঁখ বাজার আওয়াজ। কোথাও স্কুল ফেরত পড়ুয়াদের দেখা গেল রাস্তায় দিয়ে 'থ্রি চিয়ার্স ফর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়' বলতে বলতে হাঁটার দৃশ্য, আবার কোথাও দেখা গেল বাজি ফাটানোর উৎসবে মেতে ওঠা জনতাকে। দু'জন প্রতিমন্ত্রী এবং পাঁচ জন পূর্ণ মন্ত্রী-সহ জেলায় এবার মন্ত্রীর সংখ্যা সাত। সকাল থেকেই দমদম, হাবরা, বাগদা, বনগাঁ, খড়দহ, কামারহাটি সর্বত্রই দেখা গিয়েছে রাস্তার দু'ধার জুড়ে মুড়ে ফেলা তৃণমূলের পতাকা। কোথাও নেত্রীর বড় বড় কাটআউটে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে মালা। সঙ্গে মাইকে সমানে বাজছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। পথ চলতি মানুষ হঠাৎ থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখতে। ক্রমশ জমেছে ভিড়। মনে হচ্ছিল যেন হঠাৎই উধাও হয়ে গিয়েছে কাজের তাড়া।

এ দিন জেলার মন্ত্রীদের একের এযপর এক শপথ গ্রহণ শেষ হচ্ছিল আর চিৎকার করে উঠছিলেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। একে একে শপথ নিলেন অমিত মিত্র, উপেন বিশ্বাস, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর, ব্রাত্য বসু, পূর্ণেন্দু বসু। এই প্রথম বাগদা কেন্দ্র থেকে জয়ী কেউ মন্ত্রী হলেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানকার মানুষের আন্দ-উচ্ছ্বাস একটু বেশিই। মন্ত্রী পেয়ে আনেকেই আশা করছেন দীর্ঘদিনের সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। উন্নত হবে স্বাস্থ্য পরিষেবা। যেমন গৃহবধূ শ্যামলী হালদার চান সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হোক, সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমর তৈরি হোক যাতে চাষির সমস্যা মেটে। আর একজন পেশায় ব্যবসায়ী পার্থ সাহা চান স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি। পেট্রাপোল বন্দরে মুদ্রা বিনিময় ব্যবসায় যুক্ত আশিস দে চান দেশের বৃহত্তম এই স্থল বন্দরে যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশপাশি উন্নত হোক অন্যান্য পরিকাঠামে।

এদিন ছেলের মন্ত্রী হওয়ার খবরে নিজের আনন্দ চেপে রাখতে পারেননি মতুয়া মহাসঙ্ঘের বড় মা বীণাপাণি দেবী। তিনি বলেন, "আমি খুব খুশি যে ছেলে মন্ত্রী হয়েছে। মমতাকে ধন্যবাদ জানাই।" উচ্ছ্বাস মতুয়াদেরও। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক গণপতি বিশ্বাস বলেন, "খুব আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে যে ঠাকুরবাড়ির ছেলে মন্ত্রী হল। এর ফলে মতুয়াদের আরও উন্নতি হবে।"

আর মন্ত্রী হয়ে নিজে কী বলছেন মঞ্জুলকৃষ্ণবাবু?

চ্চানীয় সমস্যার দিকে বেশি করে নজর দিতে চান মন্তব্য করে মঞ্জুলকৃষ্ণবাবু বলেন, "এলাকার মূল সমস্যা আর্সেনিক। ঠাকুর পরিবারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মন্ত্রী হওায় তা আরও বেড়ে গেল। প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করব।" আগে বেশ কয়েকবার বিধায়ক হয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কিন্তু মন্ত্রী এই প্রথম। কেমন লাগছে জানতে চাইলে জেলার গুরুত্‌ূপূর্ণ এই নেতা জানালেন, "দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। হাবরার মানুষ যে ভালবাসা দিয়েছেন তার মর্যাদা রাখার চেষ্টা করব। উন্নয়নে সিপিএম-তৃণমূল দেখব না।'' এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমলা থেকে মন্ত্রী হওয়া প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাস অবশ্য অনেক সংযত। জানালেন, "যে শপথ নিয়েছি তা পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।"

দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও এ দিন উচ্ছাসে মেতে উঠতে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের কর্মী- সমর্থকদের। কয়েকজন মন্ত্রী পেয়েছে এই জেলাও। মন্ত্রী হিসাবে এদিন শ্যামল মণ্ডল, মনীশ গুপ্ত, ফিরহাদ হাকিম যখন শপথ নিচ্ছিলেন টিভিতে সেই দৃশ্য দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠছিলেন তৃণমূলের সমর্থকেরা। অনেকেই দলীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করতে বেরিয়ে পড়েন। ফাটে বাজিও।

তবে এ দিন রাজ্যে তাঁদের প্রিয় নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী হলেও তেমন উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে দেখা যায়নি উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটকে। কারণ রাজ্য সার্বিক ভাবে ভাল ফল হলেও এই মহকুমায় তেমন সাফল্য পায়নি তৃণমূল। তাই বিক্ষিপ্ত ভাবে দু'একটি জায়গায় মাইক বাজিয়ে, ছোট্ট মিছিল করে তৃণমূীল কর্মী-সমর্থকেরা আনন্দ করলেও মহকুমা জুড়ে অবশ্য উচ্ছ্বাস তেমন দেখা যায়নি।

সিঙ্গুরে জমি ফেরাতে
পারবেন তো মাস্টারমশাই

অসিত দাস

মাস্টারমশাই মন্ত্রী হয়েছেন। সিঙ্গুরবাসীর কাছে পরম প্রাপ্তি।

ভোটে তাঁর কাছে হেরেছি ঠিকই, কিন্তু ভীষণ ভাল লাগছে। মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আমার স্কুল সিঙ্গুর মহামায়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। স্কুলের বারান্দায় যখন বেত হাতে পায়চারি করতেন, তখন সিঁটিয়ে থাকতাম। আবার ক্লাসে যখন পড়াতেন, অনেক জটিল বিষয় জলের মতো সহজ করে দিতেন। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিমূর্তি। অনেক তৎসম শব্দ তাঁর কাছে শিখেছিলাম। সর্বোচ্চ কোটির সম্মান, উচ্চকোটির মানুষ-- শব্দবন্ধগুলি তাঁর মুখে প্রায়ই শুনতাম। পর পর তিন বার বিধায়ক হয়ে তিনি এ বার মন্ত্রী হওয়ার মতো উচ্চকোটির পুরস্কার পেলেন।

শপথ গ্রহণে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে সিঙ্গুরে যখন রোগী দেখা শুরু করেছি, তখন তিনি হেডমাস্টার। স্কুলে ডাকতেন। বাড়িতেও। সব সময় পেয়েছি তাঁর আন্তরিক অমায়িক ব্যবহার। বলতেন, "ডাক্তার হয়েছ খুব ভাল। তবে লেখালেখিটা চালিয়ে যাচ্ছ তো?"

রাজনীতির ময়দানে পা-রেখেও তিনি কিন্তু ছাত্রদের ভোলেননি। ২০০১ সালে প্রথম বার তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের, অর্থাৎ প্রাক্তন ছাত্রদের একটি করে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে ভোট দিয়ে জেতানোর জন্য। অনেক ছাত্রই ভোট দিয়েছিল তাঁকে। আজ মন্ত্রী হয়ে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর ছাত্রদের ভুলবেন না। তিনি কতটা সফল হবেন, তা অবশ্য ভবিষ্যৎই বলবে।

সিঙ্গুরের জটিল জমি সমস্যার সমাধানে তিনি কতটা সদর্থক ভূমিকা নিচ্ছেন, রাজনীতির একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে তা আমি দেখে যাব। তিনি বা তাঁরা কি পারবেন চারশো একর জমি ফিরিয়ে দিতে? জমি অধিগ্রহণ আইনের নাগপাশ ছিঁড়ে অনিচ্ছুক কৃষকদের হাতে জমি তুলে দিতে না পারলে কৃষকদের থামানো যাবে তো? অধিগ্রহণ আইন সংশোধন হলে তবেই জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে, এ কথায় কিন্তু ভবি ভুলবে না। ন্যানো কারখানা ফিরে আসবে কি না, সিঙ্গুরের জনগণ জানতে চাইবে তাঁর কাছে। ন্যানো না-হলে রেলের কারখানা হবে কি না, তা-ও মানুষ জানতে চাইবে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কথিত অটোমোবাইল শিল্প কি হবে তাঁর 'অটোমেটিক চয়েস'? তবে যা-ই হোক, বিনয় মজুমদারের কাব্যগ্রন্থের নাম ধার করে বলা যায়, 'ফিরে এসো, চাকা'।

শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গবাসী পিছিয়ে পড়ছে, না এগিয়ে যাচ্ছে, তা বড় আপেক্ষিক প্রতিপ্রশ্ন। এক জন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন সিঙ্গুরে একটি কলেজ হোক। অনেকেই জানেন না যে, সিঙ্গুরের এই বহুচর্চিত জনপদে একটিও কলেজ নেই। ছেলেমেয়েদের শ্রীরামপুর বা হরিপাল যেতে হয়। মাস্টারমশাইয়ের নিজের গ্রামের পাশের মাঠেই যে মিনি ডিপ টিউবওয়েলগুলো অকেজো হয়ে বহু বছর ধরে পড়ে আছে, তার কি গতি হবে? তাঁর কৃষিদরদি ভাবমূর্তির সঙ্গে ঠিক যেন মেলে না ওই নিষ্ঠুর বাস্তব। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা সব বিষয়েই আমাদের মাস্টারমশাইয়ের অনায়াস বিচরণ। আশা করব, তিনি তাঁর বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে কৃষি-শিল্প দুই বোন 'হাসি ও খুশি' এই আপ্তবাক্যটি কতটা তিনি সফল করতে পারেন, তা সময় বলবে।

শিক্ষক হিসেবে বানান ভুলের দিকে নজর দিতে বলতেন। ভুল হলে হাতে বেতের ঘা-ও পড়ত। মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্ব বইতে গিয়ে তাঁকে খুঁটিনাটি সমস্ত দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। খুঁতখুঁতে স্যারের সেটাই কিন্তু হতে পারে 'ইউএসপি'।

মন্ত্রী পেয়ে আশায় বুক বাঁধছে হাওড়া

নিজস্ব সংবাদদাতা • উলুবেড়িয়া

শুক্রবার উৎসবের ছোঁয়া লাগে উলুবেড়িয়া পূর্বকেন্দ্রের বাসিন্দাদের মনে। এই কেন্দ্র থেকে তাঁরা নির্বাচিত করে প্রাক্তন দুঁদে আইপিএস অফিসার হায়দর আজিজ সফিকে পাঠিয়েছেন বিধানসভায়। তাঁরা ভাবতে পারেননি সফিকে শেষ পর্যন্ত মমতা মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে মনোনীত করবেন। সফির শপথ নেওয়ার খবর টেলিভিশনের পর্দায় দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন তাঁরা।

শহরের মূল সমস্যা হল যানজট। স্টেডিয়ামটি অস্পম্পূর্ণ। পরিস্রুত পানীয় জল এখনও সর্বত্র পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ নেই বহু জায়গাতেই। শহরে এখনও গড়ে ওঠেনি কোনও বৈদুতিক চুল্লি। উলুবেড়িয়া পূর্ব কেন্দ্রটি শিল্প কারখানা অধ্যুষিত। কিন্তু ফুলেশ্বরে কানোরিয়া জুটমিল, বাউড়িয়ায় ফোর্ট গ্লস্টার কেবল কারখানা এবং বাউড়িয়া কটন মিল, এই তিনটি কারখানা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড এবং গ্র্যাচুইটির টাকা বকেয়া বহুদিন ধরে।

তাঁদের কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিধায়ক মন্ত্রী হয়েছেন এটা যেমন উলুবেড়িয়া পূর্ব কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কাছে আনন্দ এবং গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য দিকে তাঁরা আশা করছেন সমস্যাগুলি মেটাতে মন্ত্রী সদর্থক ভূমিকা নেবেন। উলুবেড়িয়া শহরের বাসিন্দা শান্তনু হাজরা ডাকঘরের কর্মী। তিনি বলেন, "পরিবর্তনের ঢেউ আমাদের এখানে লেগেছে। এতে আমরা আনন্দিত। কিন্তু শহরের যানজট অসহনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রীর কাছে আবেদন যানজট দূর করতে তিনি কার্যকরী ব্যবস্থা নিন। বৈদ্যুতিক চুল্লিও করা প্রয়োজন"। এই শহরেরই বাসিন্দা তথা স্কুল শিক্ষিকা শিখা সামন্ত ঘোষের দাবি, "মন্ত্রী উলুবেড়িয়া স্টেডিয়ামটির সংস্কারের ব্যবস্থা নিন।"

কানোরিয়া জুটমিলের শ্রমিক কালসাপা লস্করপাড়ার বাসিন্দা সানোয়ার মল্লিক এবং শেখ আলাউদ্দিনের দাবি, "সরকারের বদল হয়েছে। আমাদের এলাকা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক মন্ত্রীও হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা এই কারখানা খোলার জন্য তিনি উদ্যোগ নেবেন এটা আমরা আশা করি। বকেয়া প্রভিডেন্ট ফাণ্ড এবং গ্র্যাচুইটির টাকাও যাতে আমরা পাই সেই চেষ্টাও মন্ত্রী করবেন এটাই আমরা চাই।"

বাউড়িয়ার বাসিন্দা সমাজসেবী রহিমা বেগম সফিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, "আমাদের এলাকা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক মন্ত্রী হয়েছেন। এ জন্য আমরা খুশি। একইসঙ্গে আশা করব রাজ্যের সঙ্গে এই এলাকারও তিনি উন্নয়ন করবেন। সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করবেন।" মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে খলিসানির বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী অভিজিৎ মণ্ডল বলেন, "মন্ত্রী হিসাবে তিনি সারা রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ তো করবেনই। যেহেতু তিনি আমাদের এলাকার বিধায়ক তাই তাঁর কাছ থেকে আমরা একটু বেশিই আশা করি।"

সফির মন্ত্রী হওয়ার খবরে উলুবেড়িয়া পূর্ব কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় বাসিন্দাদের মধ্যে খুশি ছড়িয়ে পড়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার সময় বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। একই ঘটনা ঘটে সফির শপথ নেওয়ার সময়েও। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় শপথ নেন সফি। সঙ্গে সঙ্গে ফুলেশ্বর রেল স্টেশনের কাছে তৃণমূল কর্মী সমর্থকেরা পথচারীদের মধ্যে মিষ্টি বিলি শুরু করেন। সঙ্গে দেওয়া হয় সরবত।


পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর

মমতা'র মন্ত্রিসভায়
পূর্বের দুই বিধায়ক

নিজস্ব সংবাদদাতা, তমলুক ও হলদিয়া: রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অগ্রণী জেলা পূর্ব মেদিনীপুর থেকে নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেন দুই বিধায়ক—তমলুক থেকে জয়ী সৌমেন মহাপাত্র ও মহিষাদল থেকে জয়ী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার। রাজ্যে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানায় কাঁথি থেকে একাধিক মন্ত্রী হলেও তমলুক মহকুমা থেকে মাত্র একবারই মন্ত্রী হয়েছিলেন পাঁশকুড়ার ওমর আলি।


দুই চিকিৎসক মন্ত্রীরই উদ্দেশ্য সার্বিক উন্নয়ন

নিজস্ব প্রতিবেদন: দু'জন পূর্ণমন্ত্রী পেল পশ্চিম মেদিনীপুর। দু'জনেই আবার চিকিৎসক। সবং থেকে জয়ী মানস ভুঁইয়া ও ঝাড়গ্রামের বিধায়ক সুকুমার হাঁসদা শপথ নিলেন শুক্রবার। মানসবাবু আগাগোড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবে পরিবারে রাজনৈতিক আবহ থাকলেও কোনও দিনই সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না সুকুমারবাবু। ব্যস্ত ছিলেন চিকিৎসকের পেশা নিয়ে।


ক্ষমতায় নতুন সরকার, জেলা প্রশাসন তৎপর

নিখোঁজ ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র টুকরো খবর

মেদিনীপুর ও খড়্গপুর

নারায়ণগড়ে
দু'দলের সংঘর্ষ

নিজস্ব সংবাদদাতা, মেদিনীপুর: শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শপথ নিল তাঁর মন্ত্রিসভা। তবে এই দিনটিতেও রাজনৈতিক হিংসায় দাঁড়ি পড়ল না পশ্চিম মেদিনীপুরে। এ দিন নারায়ণগড়ের বিরবিরা গ্রামে তৃণমূলের লোকজনদের উপর সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ।


নিজস্ব সংবাদদাতা, মেদিনীপুর: ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ১টা বেজে ১ মিনিট। মাইকে বাজতে থাকা সানাইয়ের সুর ম্লান করে দিল শব্দবাজির দাপট। সেই সঙ্গে জয়ধ্বনি। জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণের দৃশ্য। যাঁরা রাজভবনে গিয়েছেন, তাঁরা সামনে থেকে দেখেছেন। যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের ভরসা জায়ান্ট স্ক্রিন।

শপথ ঘিরে
মাতল শহর


তৃণমূলের
গোষ্ঠী সংঘর্ষ
প্রত্যাশা
ও প্রতিশ্রুতি


চিত্র সংবাদ


calcutta




No comments: